পৌরকর নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় তা নিরসনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) বিভিন্ন স্থাপনা পুনর্মূল্যায়ন করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। করা হবে যৌথ সার্ভে। এ লক্ষ্যে গঠিত কমিটিতে চসিক ও বন্দরের দুইজন করে চারজন এবং মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি থাকবে। আগামী ২০ আগস্ট থেকে যৌথ সার্ভে শুরু হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বকেয়াসহ চলতি ২০২৫–২০২৬ অর্থবছরের ১৭৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা পৌরকর পরিশোধে গত ১০ জুলাই বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিল দেয় চসিক। এর মধ্যে নির্ধারিত হাল পৌরকর ধরা হয় ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এরপর ২৭ জুলাই বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে চলতি অর্থবছরের পৌরকর পরিশোধে আপত্তি জানায়। চবকের দাবি, চলতি অর্থবছরে পৌরকর খাতে কোনো বকেয়া নেই। এরপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার বন্দর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে চবকের বিভিন্ন স্থাপনা পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা জানায় চসিক।
ওই চিঠিতে বলা হয়, সিটি কর্পোরেশনসমূহের (কর) বিধি, ১৯৮৬ এর ধারা ২১ অনুসারে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পৌরকর পুনর্মূল্যায়নের এখতিয়ার সিটি কর্পোরেশনসমূহকে দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী কর বিধি, ১৯৮৬ এর ধারা ২০ মোতাবেক ২০১৭–২০১৮ অর্থবছরের ১ম কোয়ার্টারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সার্ভের মাধ্যমে কর পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। যেহেতু ২০২১–২০২২ অর্থবছরে পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়েছে, তাই পুনরায় যৌথ সার্ভের মাধ্যমে পৌরকর নির্ধারণের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের স্থাপনার বিপরীতে পুনর্মূল্যায়নের কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে আগামী ২০ আগস্ট উভয় সংস্থার সমন্বয়ে যৌথ সার্ভের মাধ্যমে পৌরকর পুর্নমূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করার কথাও বলা হয়। সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রস্তাব ছিল
১৬০ কোটি টাকা। কিন্তু বন্দর দিয়ে আসছে ৪৫ কোটি টাকা করে। এখন যৌথ সার্ভে করে আবার নির্ধারণ করা হবে। গত পাঁচ বছরে বন্দরের নতুন নতুন স্থাপনা হয়েছে। তাদের আয় বেড়েছে। তাই যৌথ সার্ভে হলে পৌরকরের হার বাড়বে আশা করছি।
তিনি বলেন, শহরের অধিকাংশ রাস্তা ৬–১০ টন বোঝার গাড়ির জন্য নির্মাণ করা হলেও বন্দরের পণ্যবাহী ৫০–৬০ টনের বোঝা নিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। বন্দরে পণ্য আনা–নেওয়া করা হাজার হাজার ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করায় শহরের অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর, জেটি হতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সড়কে অসংখ্য ভারী যানবাহন চলাচল করে। বন্দরমুখী সড়কগুলো এ কারণেই প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। বন্দরের ভারী যানবাহনের কারণে নিয়মিত রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিবছর কর্পোরেশনের অতিরিক্ত ৪০০–৫০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তাই বন্দরের উচিত ন্যায্য পৌরকর পরিশোধ করে নগরের রাস্তাঘাট সংস্কারে ভূমিকা রাখা।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক :
চসিকের আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়ার পাশাপাশি গতকাল চবক ও চসিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়। বন্দর ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের বন্দরের পক্ষে ছিলেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান, বন্দর পরিচালনা পর্ষদ সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. হাবিবুর রহমান ও বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক। চসিকের পক্ষে ছিলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম সরওয়ার কামাল। ওই বৈঠকে, দুই সংস্থার পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে যৌথ সার্ভের সিদ্ধান্ত হয়। যৌথ সার্ভের মাধ্যমে যে পৌরকর নির্ধারণ হবে তাই বন্দর পরিশোধ করবে বলেও মেনে নেয়।
বৈঠকের বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, যৌথ সার্ভে করলে পৌরকর বাড়তেও পারে।
১৬০ কোটি টাকা যেভাবে ৪৫ কোটি টাকা হল :
২০১৭ সালে চসিকের পঞ্চবার্ষিকী করপুর্নমূল্যায়নে চবকের কাছে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পৌরকর প্রস্তাব করা হয়। তবে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে এ করপুর্নমূল্যায়ন কার্যক্রম স্থগিত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। যা ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর প্রত্যাহার করা হয় (কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে)। এরপর চবককে পুর্নমূল্যায়নের আলোকে পৌরকর পরিশোধ করতে বলে চসিক। কিন্তু আপত্তি জানায় সংস্থাটি। এরপর ২০২১ সালের ১৪ জুলাই চসিক ও বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করতে বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও। ওই বৈঠকে ৫০ কোটি টাকা পৌরকর চূড়ান্ত করা হয়। কিস্তু বন্দর পরিশোধ করে ৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ শতাংশ সারচার্জ মওকুফের সুবিধা নিয়ে পরিশোধ করে মাত্র সাড়ে ৪০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত চসিকের সাধারণ সভায় তা অনুমোদন দেন তৎকালীন মেয়র রেজাউল।
তবে গত বছর মেয়রের দায়িত্বগ্রহণের পর ডা. শাহাদাত হোসেন ১৬০ কোাটি টাকার পুরোটা আদায়ের উদ্যোগ নেন। তিনি ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর চবক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় চসিক। এতে অর্থবছরটির (২০২৪–২০২৫) বন্দরের পরিশোধিত অংক বাদ দিয়ে বাকি ১১৫ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। এরপর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি নৌপরিবহন সচিবকেও চিঠি দেয় চসিক। এতে চসিকের প্রস্তাবিত পৌরকর পরিশোধে চবককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে বলা হয়।
এরপর ১৬০ কোাটি টাকার পুরোটা আদায়ের উদ্যোগ নেয়ার পর গত বছরের (২০২৪) ১৫ ডিসেম্বর চবক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় চসিক। এতে চলতি অর্থবছরে (২০২৪–২০২৫) বন্দরের পরিশোধিত অংক বাদ দিয়ে বাকি ১১৫ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। পত্রে বলা হয়, চলতি অর্থবছর থেকে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পৌরকর ধার্য করা হয়।
এরপর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি নৌপরিবহন সচিবকেও চিঠি দেয় চসিক। এতে চসিকের প্রস্তাবিত পৌরকর পরিশোধে চবককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে বলা হয়। এরপ্রেক্ষিতে গত ৬ এপ্রিল প্রেক্ষিতে চসিককে আপাতত ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করার নির্দেশনা দিয়ে চবক চেয়ারম্যানকে দাপ্তরিক পত্র দেয় নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয়। এরপর ১৬ এপ্রিল বকেয়া পৌরকরের ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করে চবক।
অতঃপর জটিলতা :
গত এপ্রিলে চসিককে ১০০ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশনা দিয়ে চবককে নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দেয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘জয়েন্ট সার্ভে কমিটির রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে কম–বেশি সমন্বয়ের শর্তে আপাতত ১০০ কোটি টাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে প্রদান করা যেতে পারে।’
এদিকে চসিক থেকে চবককে চলতি অর্থবছরের পৌরকরের বিল দেয়ার পর জয়েন্ট সার্ভে (যৌথ সার্ভে)-এর বিষয়টি সামনে আনে চবক। এ বিষয়ে চসিককে দেয়া চিঠিতে চবক দাবি করে, ‘২০২১–২২ অর্থ বছরে পৌরকর বার্ষিক ৪৫ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়, যা ২০২৫–২৬ অর্থবছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ১০০ কোটি টাকা এসেসমেন্ট বা যৌথ সার্ভের মাধ্যমে ধার্যকৃত পৌরকরের সাথে সমন্বয়ের শর্তে পরিশোধ করা হয়। ২০২৫–২০২৬ অর্থবছরের পৌরকর ৪৫ কোটি টাকা (রিবেট সুবিধাসহ) সমন্বয় হওয়ার পরও অতিরিক্ত ৫৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা পৌরকর খাতে পরিশোধিত আছে। একই চিঠিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক সরেজমিনে জয়েন্ট সার্ভে করে বিধিমতে পৌরকর ধার্য করার জন্য চসিককে অনুরোধ করে চবক।