চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য প্রায় ৯শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৪টি ইক্যুইপমেন্ট কেনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কেনা হচ্ছে এসব ইক্যুইপমেন্ট। এসব ইক্যুইপমেন্টের মধ্যে শুরুতে আনা হচ্ছে বন্দরের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ধারণক্ষমতার দুটি মোবাইল ক্রেন। আগামী মাস কয়েকের মধ্যে প্রতিটি ১০০ টন ধারণক্ষমতার এই দুইটি ক্রেন বন্দরের বহরে যুক্ত হবে। কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আনুষাঙ্গিক অন্যান্য ইকুইপমেন্টও ক্রমান্বয়ে এসে পৌঁছাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের অনেক ইক্যুইপমেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় উৎপাদনশীলতা কমে গিয়েছিল। নতুন ইক্যুইপমেন্টগুলো যুক্ত হলে বন্দরের উৎপাদনশীলতা প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টারা।
বন্দরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ইক্যুইপমেন্টের আয়ুষ্কাল ফুরাতে শুরু করেছে। বহু যন্ত্রই আর ঠিকঠাকভাবে কাজ করে না। এতে বন্দরের উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দিন দিন বন্দরের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে ইক্যুইপমেন্টের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার বিষয়টি ব্যবহারকারীদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইক্যুইপমেন্ট কেনার জন্য স্মরণকালের বৃহত্তম একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৪টি ইক্যুইপমেন্ট কেনার উদ্যোগ নেয় বন্দর। ইক্যুইপমেন্টগুলো হচ্ছে চারটি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, ১১টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরটিজি), ২১টি ফোর-হাই স্ট্র্যাডেল ক্যারিয়ার, ৬টি টু-হাই স্ট্র্যাডেল ক্যারিয়ার, ৪টি রীচ স্টেকার (লোড) ৪টি, ২টি কন্টেনার মোভার, ৪টি ভেরিয়েবল রীচ ট্রাক (৪৫ টন), ২টি মোবাইল ক্রেন (১০০ টন), ২টি মোবাইল ক্রেন (৫০ টন), ২টি মোবাইল ক্রেন (৩০ টন), ১২টি মোবাইল ক্রেন (২০ টন), ২৩টি মোবাইল ক্রেন (১০ টন), ২টি লগ হ্যান্ডলার-স্টেকার, ৪টি ফর্ক লিফট ট্রাক (২০ টন), ১টি ম্যাটেরিয়াল-মাল্টি হ্যান্ডলার (৩৫ টন), ২টি লো বেড ট্রেইলার ও ২টি হেভী ট্রাক্টর পাওয়ার রয়েছে। এসব ইকুইপমেন্টগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ৪টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন কেনার জন্যই খরচ হবে আড়াইশ’ কোটি টাকারও বেশি। এসব গ্যান্ট্রি ক্রেন বন্দরের বহরে যুক্ত হলে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) পুরোপুরি গ্যান্ট্রি ক্রেনের আওতায় চলে আসবে বলে জানা যায়। বন্দরে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে কী গ্যান্ট্রি ক্রেনই সর্বাপেক্ষা আধুনিক এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি হিসেবে বিবেচিত। অপরদিকে বর্তমানে চট্টগ্রামে বন্দরে প্রতিটি ৮৪ টন ধারণক্ষমতার ৩টি মোবাইল ক্রেন রয়েছে। এগুলোই বন্দরের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বেশি ধারণক্ষমতার ক্রেন। নতুন করে ১০৪টি ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ প্রকল্পের আওতায় দুটি ১০০ টন ধারণক্ষমতার ক্রেন কেনা হচ্ছে। এই দুটি ক্রেন চট্টগ্রাম বন্দরের ইক্যুইপমেন্ট বহরের ইমেজ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (যান্ত্রিক) মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ১০৪টি ইক্যুইপমেন্ট ক্রয় প্রকল্পের কথা নিশ্চিত করে বলেন, শুরুতে একশ টন ধারণক্ষমতার ২টি মোবাইল ক্রেন আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই ক্রেন সরবরাহ দেয়ার জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়েছে। বাকি ইক্যুইপমেন্ট ক্রমান্বয়ে আসবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কী গ্যান্ট্রি ক্রেন কেনার ব্যাপারে বেশ লম্বা সময় লাগে। এই ক্রেন তৈরি অবস্থায় থাকে না। ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার পর সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ক্রেন প্রস্তুতের কাজ শুরু করে। এতে দশ মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। আমাদের ১০৪ ইক্যুইপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় যেই চারটি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন রয়েছে সেগুলো আসতে আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে আরটিজি এবং অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইক্যুইপমেন্টগুলো যত দ্রুত সম্ভব আনা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড এডমিন) মোহাম্মদ জাফর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটি বেশ বড় ধরনের একটি প্রকল্প। চট্টগ্রাম বন্দরকে আরও বেশী গতিশীল করতে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন ইক্যুইপমেন্ট বহরে যুক্ত হলে কন্টেনার হ্যান্ডলিং-এর পাশাপাশি কার্গো হ্যান্ডলিং কাজেও গতিশীলতা তৈরি হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ড দিন দিন যে হারে বাড়ছে তাতে এসব ইক্যুইপমেন্ট কেনার কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, এসব ইক্যুইপমেন্ট বন্দরে পৌঁছলে আমরা কেবল সিসিটি কিংবা এনসিটিই নয়, জেসিবিতেও ইক্যুইপমেন্ট দিতে পারব। ইতোমধ্যে জেসিবির ইয়ার্ডগুলোকে উন্নত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করে মোহাম্মদ জাফর আলম বলেন, এসব ইয়ার্ডেও যাতে আধুনিক কন্টেনার হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট চালানো যায় সেজন্যই ইয়ার্ড উন্নয়নের কাজে হাত দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০৪৩ সালে দেশে কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিমাণ ১ কোটি ৩০ লাখ টিইইউএস-এ উন্নীত হবে। বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর গতিশীলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন নতুন ইক্যুইপমেন্ট কেনার কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১৪ সালে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ২১৯ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছিল। ২০১৫ সালে ২০ লাখ ২৪ হাজার ২০৭ টিইইইউএস, ২০১৬ সালে ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৯ টিইইউএস , ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার টিইইউস। ২০১৮ সালে ২৯ লাখ তিন হাজার টিইইউস। ২০১৯ সালে ৩১ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছে। চলতি ২০২০ সালে ভয়াল করোনার মাঝে আমদানি রপ্তানিতে কিছুটা ধস নামলেও কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিমাণ ৩৩ লাখ টিইইউএস পার হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞ সামলাতে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ইক্যুইপমেন্ট বহর সমৃদ্ধ করতে হবে বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ১৪টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ সর্বসাকুল্যে ১২৫টি ইক্যুইপমেন্ট রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে বিশ্বের ব্যস্ততম একশ’ কন্টেনার হ্যান্ডলিংকারী বন্দরের তালিকায় ৫৮তম স্থানে রয়েছে।