বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে শিপিং এজেন্টদের বিরোধ

কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা কমানো নিয়ে দুই পক্ষের ভিন্ন অবস্থান সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বন্দর চেয়ারম্যানকে শিপিং এজেন্টস এসো’র চিঠি

হাসান আকবর | বুধবার , ২০ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা কমানো নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে শিপিং এজেন্টদের বিরোধ হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টের সাথে চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অপরদিকে জাহাজগুলো যেকোনো মূল্যে চালু রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন। বন্দর কর্তৃপক্ষের মতে, জাহাজের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বন্দরের সার্বিক কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে। বহির্নোঙরে জট এবং জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। আর শিপিং এজেন্টদের বক্তব্য হচ্ছে, প্রতিটি জাহাজের কোম্পানিই আলাদা। এখন কার জাহাজ কে বন্ধ করাবে? বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে শিপিং এজেন্টদের আলাদা করে ডেকে কথা বলার উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রামসিঙ্গাপুর কিংবা চট্টগ্রামকলম্বো রুটে চলাচলকারী ফিডার সার্ভিসের ভাড়া বেশি হওয়ায় এই রুটে চলাচলের সুযোগ পাওয়া কোনো জাহাজই আর সুযোগটি হাতছাড়া করতে রাজি হচ্ছে না বলেও সূত্রে জানা গেছে। এদিকে শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন বন্দর চেয়ারম্যান বরাবরে গতকাল দেয়া একটি চিঠিতে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা জাহাজ কমানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছে।

দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দরের মাধ্যমে আমদানিরপ্তানির প্রায় ৯৩ শতাংশ পণ্য এবং কন্টেনারের প্রায় ৯৯ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে একইসাথে সর্বোচ্চ ১৩টি কন্টেনার জাহাজ বার্থিং দেয়া সম্ভব। একটি জাহাজকে গড়ে তিন দিন জেটিতে অবস্থান করতে হয়। এই হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরে যে সক্ষমতা গড়ে তোলা হয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ১০০টি কন্টেনার জাহাজ হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হয়। এর বেশি হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সংকটে পড়ে। বহির্নোঙরে জাহাজের জট এবং অবস্থানকাল বাড়তে থাকে। এছাড়া জেটিতে থাকা জাহাজে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য লোডআনলোড সম্পন্ন করতে না পারলে নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ যাত্রা করতে পারে না। ফলে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইমও বেড়ে যায়।

চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলের জন্য মোট অনুমোদিত কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা ছিল ৯৬টি। ওই সময় বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বা ওয়েটিং টাইম ছিল ১ থেকে ২ দিন এবং অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা ছিল ৭ থেকে ৮টি। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর এবং কলম্বোতে চট্টগ্রামমুখী কন্টেনারের জট সৃষ্টি হলে জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে হয়। এডহক ভিত্তিতে বেশ কিছু জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই জাহাজগুলোসহ বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচল করছে ১১৮টি ফিডার জাহাজ। সক্ষমতার চেয়ে ১৮টি জাহাজ বেশি হওয়ায় বন্দরে জাহাজজট এবং বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বা ওয়েটিং টাইম বেড়ে গেছে বলে দাবি করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাহাজের সংখ্যা ৯৬ থেকে ১০০টির মধ্যে নির্দিষ্ট রাখার লক্ষ্যে জাহাজের সংখ্যা কমানোর তাগাদা দেয়া হয়। ওই সভায় ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে কমপক্ষে ১৫টি জাহাজ কমিয়ে তার তালিকা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট প্রদান করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন কিংবা বাংলাদেশ কন্টেনার শিপিং এসোসিয়েশন একটি জাহাজও কমাতে পারেনি। এ ব্যাপারে কোনো তালিকাও প্রদান করতে পারেনি। ফলে ২৯ জুলাই ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৫টি জাহাজ কমিয়ে তালিকা প্রদানের তাগাদা দিয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু ওই ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশন কোনো জাহাজ কমাতে পারেনি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিটি শিপিং এজেন্টকে আলাদা করে ডেকে জাহাজ কমানোর ব্যাপারে তাগাদা দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে একটি পত্র দিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। তারা জাহাজ কমানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ আজাদীকে বলেন, এখন বন্দর পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। কোনো জটও নেই। তাহলে শুধু শুধু আমাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে জাহাজ কমানোর জন্য চাপ দেয়া ঠিক হচ্ছে না। আমরা চিঠি দিয়ে বিষয়টি বন্দর চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। জাহাজ কমানোর সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করে একটি চিঠি দিয়েছি। আমরা বলেছি, জাহাজ কমালে বন্দরের ইমেজ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যবসাবাণিজ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গিয়ার্ড ও গিয়ারলেস জাহাজের সংখ্যা হ্রাসের প্রস্তাব করা হলেও সে বৈঠকে বিএসএএর প্রতিনিধি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। পরবর্তীতে আমরা দফায় দফায় চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছি। একই মতামত বাংলাদেশ কন্টেনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ) থেকেও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৩০ জুলাই সদস্য জাহাজ পরিচালকদের জরুরি সভায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেই আলোচনার ভিত্তিতেই বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি কনজারভেটরের কাছে যুক্তিসম্মত মতামত পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, সমিতির পক্ষে মতামত দেওয়া সত্ত্বেও সদস্য জাহাজ পরিচালকদের আলাদাভাবে সভায় তলব করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি বন্দরে জাহাজের বার্থিং ডিলে বা বিলম্ব অনেকটাই কমে এসেছে। বিদ্যমান নীতিমালা অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণির জাহাজ পরিচালনা অব্যাহত থাকলে এ পরিস্থিতি আরো উন্নত হবে। ফলে জাহাজের সংখ্যা কমানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এ অবস্থায় বিএসএএ আবারও স্পষ্টভাবে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে বিষয়টিতে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ এবং সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক কারণে পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে।

চিঠির কপি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এইচ অ্যান্ড এম), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দপ্তর, ডেপুটি কনজারভেটর, ট্রাফিক পরিচালক, বিজিএমইএ সভাপতি এবং বিএসএএর সব সদস্য এজেন্টের কাছে পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে যে সকল কন্টেনার জাহাজ পরিচালিত হয় তার বেশিরভাগই ফিডার জাহাজ। অর্থাৎ চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর, কলম্বো, পোর্ট কেলাঙ ইত্যাদি বন্দর পর্যন্ত যাতায়াত করে। সুষ্ঠুভাবে বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্যকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে মাসে আনুমানিক ১০০টি জাহাজ চলাচলের ফ্যাসিলিটি গড়ে তুলতে পেরেছে। এই জাহাজগুলো তাদের পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার এবং কোনো টেকনিক্যাল ত্রুটি না থাকলে বছরে প্রায় ৪ মিলিয়ন বা চল্লিশ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে পারে। ২০২৪২৫ অর্থবছরে ৩.২৯ মিলিয়ন বা ৩২ লাখ ৯০ হাজার টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। জাহাজসমূহের অব্যবহৃত ক্যাপাসিটি সঠিকভাবে ব্যবহার, ত্রুটিমুক্ত জাহাজ চলাচল, স্বল্পতম সময়ে জাহাজের কার্যক্রম সম্পাদন এবং চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোগত সুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজের সংখ্যা নির্ধারণ করে। ফিডার অপারেটরসহ অন্যান্য সকল বন্দর ব্যবহারকারীও এই ব্যবস্থার সুফল ভোগ করেন।

বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষে বলা হয়, গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুদ্ধাবস্থার কারণে শিপিং রুটে পরিবর্তন এবং নানাভাবে বিঘ্ন ঘটেছে। দেশে বিভিন্ন ধরনের ধর্মঘট, কলম বিরতি, কর্মবিরতিসহ নানা কারণে ফিডার অপারেটরগণ নির্দিষ্ট পরিমাণ জাহাজ ব্যবহার করে আমদানিরপ্তানি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন। দেশের আমদানিরপ্তানিকারীগণকে সহযোগিতা প্রদান, ফিডার অপারেটরদের কার্যক্রমে গতি আনতে বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ফিডার অপারেটরদের পারস্পরিক সম্মতিতে কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে এডহক ভিত্তিতে ১২৬টি করা হয়। এতে সাময়িকভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক ধারণক্ষমতার ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়। জাহাজের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ সময় বেড়ে যায়, বন্দরের ইয়ার্ডে অতিরিক্ত কন্টেনার জড়ো হয়। তাছাড়া এডহক ভিত্তিতে চলাচলের অনুমতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জাহাজগুলো তাদের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়।

বর্তমানে এসব বাড়তি জাহাজ বন্দরের সার্বিক অপারেশনাল কার্যক্রম ব্যাহত করছে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থেই জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুলাই সনদের কয়েকটি দফা নিয়ে বিএনপির আপত্তি আছে : সালাহউদ্দিন
পরবর্তী নিবন্ধপবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা আজ