বনের ফুসফুসে বালুর অস্ত্র

সিন্ডিকেট অপ্রতিরোধ্য, লোহাগাড়ায় পাহাড় কাঁদে

মোহাম্মদ মারুফ, লোহাগাড়া | বৃহস্পতিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:১২ পূর্বাহ্ণ

লোহাগাড়ায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বারবার অভিযানের পরও বন্ধ করা যাচ্ছে না পাহাড় কেটে শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন। উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাতগড় লম্বাশিয়া এলাকায় পাহাড় কেটে এ বালু তোলা হচ্ছে। ওইস্থানটি চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চুনতি রেঞ্জের সাতগড় বনবিটের আওতাধীন। বনের ফুসফুস ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হচ্ছে বালু তোলার অস্ত্র দিয়ে। এতে পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সংরক্ষিত বন মানে শুধু গাছ নয়; এটি এলাকার জলবায়ু, প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বন্যপ্রাণী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার প্রতীক। যদি এখনই এ ধ্বংসযজ্ঞ থামানো না যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতে সবুজ পাহাড় এক ভয়াবহ শূন্যতায় পরিণত হবে।

জানা যায়, প্রায় এক যুগ যাবত ওই এলাকা থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একটি মহল পাহাড় কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে। দফায় দফায় অভিযানের পরও স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন। ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর ওই এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করে। ২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি বালুবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য তৈরি করা রাস্তার একাধিকস্থানে কেটে দিয়ে লম্বাশিয়ায় সংরক্ষিত বনের পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন বন্ধে স্থায়ী পদক্ষেপ নেয় উপজেলা প্রশাসন ও বনবিভাগ। কয়েক মাস বালু উত্তোলন বন্ধও ছিল। তখন ফিরে পেয়েছিল বনের প্রাণ। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে একটি মহল কাটা রাস্তা মেরামত করে পুণরায় ওই স্থান থেকে বালু উত্তোলন শুরু করে। গত ২০ মার্চ ওই এলাকায় উপজেলা প্রশাসন ও বনবিভাগ যৌথ অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয় পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন। এ সময় কাটা হয়েছিল বালু পরিবহনের ৫টি রাস্তা। অভিযানের পর কিছুদিন বালু উত্তোলন বন্ধ থাকলেও কেটে দেয়া রাস্তা আবার সংস্কার করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুণরায় নির্বিচারে বালু উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী মহল। ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর একই স্থানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গভীর গর্তের পানিতে পড়ে মারা যায় একটি বন্যহাতি। ইতোমধ্যে বালুখেকোরা বেশ কয়েকটি পাহাড় ও টিলা সাবাড় করে দিয়েছে। বালুখেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না।

স্থানীয় লোকজন জানান, এক সময় লম্বাশিয়া ছিল সবুজে ঘেরা পাহাড়, বন্যপ্রাণীতে পরিপূর্ণ এক প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল। আজ সেখানে শোনা যায় শুধু ডাম্প ট্রাকের গর্জন আর পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন যন্ত্রের কানফাটা আওয়াজ। এ যেন সংরক্ষিত বনে চলছে পাহাড় ধ্বংসের প্রতিযোগিতা। প্রকৃতির নিস্তব্ধতা প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে অভিযানে গেলেও তা লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। অভিযানের পর কিছুদিন বালু উত্তোলন বন্ধ থাকে, পুণরায় চালু হয়। কিন্তু জড়িতরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। লম্বাশিয়ায় পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে না পারার ব্যর্থতা কে নিবে প্রশ্ন স্থানীয়দের। তাহলে কি প্রশাসনের চেয়ে বালুখেকোরা শক্তিশালী? এছাড়া ওই স্থানটি এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদকসেবীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলেও পরিণত হয়েছে।

গত ২২ এপ্রিল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড় কেটে একাধিক শ্যালো মেশিন বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড় ও গাছপালা। সৃষ্টি হয়েছে ছোটবড় অনেক গর্ত। প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হচ্ছে। ভারি যানবাহন চলাচলের কারণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে গ্রামীণ সড়ক। বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে বিলীন হয়ে যাবে লম্বাশিয়ার সব পাহাড়। আবাসস্থল হারাচ্ছে বন্যপ্রাণী। বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এ সময় লশ্বাশিয়ায় সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে বালু উত্তোলন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা মেশিন বন্ধ করে পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে বালুখেকোদের লালিত কয়েকজন সন্ত্রাসী এসে পাহাড়ের ক্ষত চিহ্ন ও বালু উত্তোলনের ছবি তোলা এবং ভিডিও ধারণ করতে নিষেধ করেন। নিষেধ অমান্য করলে হামলা করে হাতপা ভেঙে দেয়ারও হুমকি দেয়। এ সময় বালু উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকদের বিশ্রামের জন্য তৈরি করা টং ঘরে মাদক সেবনের সরঞ্জামও দেখা গেছে।

স্থানীয় পরিবেশকর্মী সানজিদা রহমান জানান, সংরক্ষিত বনে নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে মানবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। এরমধ্যে নিচে নামছে পানির স্তুর, বেড়েছে ভূমি ক্ষয় ও ধসের ঝুঁকি, শিশু ও বৃদ্ধদের মাঝে শ্বাসকষ্ট, আবহাওয়া হয়ে উঠেছে শুষ্ক ও অস্বাভাবিক, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল, বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তন ও খরা প্রবণতা, বর্ষাকালে বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে জলাধার ও খাবারের উৎস, বনে খাদ্য সংকটে বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া পাহাড় কেটে বালু উত্তোলনের পাশাপাশি উজাড় করা হচ্ছে বনের গাছ ও বন দখল করে গড়ে উঠেছে বসতি। বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয় এখন হয়ে উঠেছে মানুষের লোভের লীলাভূমি। বনের আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। পাহাড়ের কান্না শুনতে পান না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সংরক্ষিত বন যেন এখন কেবল ‘নাম সংরক্ষিত’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতি বার বার ডাকছে ‘আমাকে রক্ষা করো, নয়তো একদিন তোমরাও রক্ষা পাবে না’।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন ফয়সল জানান, উপজেলা প্রশাসন ও বনবিভাগের যৌথ অভিযানে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অবহিত করা হলে তারাও অভিযানে অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়া ২০২৩ সালে লম্বাশিয়ায় পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন করায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করেছে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চুনতি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবীর ফাহাদ বলেন, লম্বাশিয়ায় পাহাড় কেটে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে কিছুদিন পর পর অভিযান পরিচালনা করে মামলা দেয়া হচ্ছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না বালু উত্তোলন। বনবিভাগের অনেক কাজ, শুধু লম্বাশিয়া নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। এদিকে রয়েছে জনবল সংকটও। অপ্রতিরোধ্য বালু সিন্ডিকেট একের পর এক পাহাড় কেটে সাবাড় করার ব্যাপারে জানতে চাইলে সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে উল্টো এর সমাধান চান ওই কর্মকর্তা।

লোহাগাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুন লায়েল বলেন, লম্বাশিয়ায় সংরক্ষিত বনে পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন বন্ধে বনবিভাগকে সাথে নিয়ে কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানের পর কিছুদিন বন্ধ থাকলেও পুণরায় বালু উত্তোলন শুরু করা হয়। বনবিভাগ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করলে লম্বাশিয়া এলাকায় একটি পাহাড়ও রক্ষা করা যাবে না। এছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে পুণরায় অভিযান পরিচালনা করা হবে জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামী ব্যাংকে দেড়শ কোটি টাকার এলসি পেমেন্ট আটকা
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে ঘরে ডেকে নিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ, যুবকের যাবজ্জীবন