জন্ম থেকেই মানুষের কাছে অরণ্য অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে আছে। প্রথমত মানব সভ্যতাও অরণ্য কেন্দ্রিক ছিল। কালের বিবর্তনে সভ্যতা যতই এগিয়েছে, সভ্যতার অগ্রযাত্রায় মিশে আছে যান্ত্রিকতার ছোঁয়া। বনের সৌন্দর্য নষ্ট করে নগরায়ণ সৃষ্টির তাগিদে যন্ত্র দানবের প্রভাব হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। আর এমনি ধ্বংসাত্মক অনুভূতির মাঝেই তো আমাদের যান্ত্রিক সভ্যতা সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বন–বনানী বৃক্ষ নিধন কাজে আমাদের বিবেকবোধ পরাভূত। বন–বনানী এখন বহুতল আবাসন, শিল্পকারখানা নির্মাণের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির সবুজ বনানীর প্রাণকেন্দ্রে আজ–কাল ইট পাথরের জঙ্গল গড়ে উঠেছে। কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক কারণে বন বনানী বিলুপ্ত হওয়ায় বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ আজ হুমকির মুখে। অথচ জীববৈচিত্র্যের অবাধ অফুরন্ত ভান্ডার হচ্ছে বন। বন–বনানী আছে বলেই উদ্ভিদ ও প্রাণী বেঁচে আছে।
বন পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় মোট ভূমির ২৫ ভাগ বন থাকার প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশে বনাঞ্চল আছে অনেক কম। বন অক্সিজেন বৃদ্ধি করে, বিষাক্ত কার্বণ–ডাইঅক্সাইড কমায়, ভূমিধ্বস রোধ করে, বন্যা–খরা, ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও টর্নেডো প্রতিরোধ করে। ঘন বন–বনানী ভূপৃষ্ঠে অধিক বৃষ্টি নামাতে সহায়ক। ধরিত্রীকে শস্যশ্যামলা করতে অরণ্য যে অবদান রাখছে সে অরণ্যের প্রতি মানুষের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কোনো শেষ নেই। যথেচ্ছভাবে গাছপালা কেটে উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে বন–বনানী। এ অপব্যবহারের পরিণতি মানুষকে ভুগতে হচ্ছে অধিক মাত্রায়। বন ও পরিবেশ ধ্বংসের নেতিবাচক প্রভাবে প্রকৃতিতে নানাবিধ পরিবর্তন ঘটে থাকে। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, তাপ দাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠা, বৃষ্টির জন্য হাহাকার সবকিছুই ঘটছে প্রকৃতি দূষণের কারণে। মানুষ এবং প্রাণীকুলের জীবন দুর্বিষহ হওয়ার মূলে রয়েছে নির্বিচারে বনানী ধ্বংস করে প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন করে তোলা।
বাংলাদেশে এক সময় গভীর বন বনানী ছিল যেখানে বন্যপ্রাণী, পাখি এবং সরীসৃপরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতো। মানুষের লোভের কারণে নির্বিচারে বনানী ধ্বংসের ফলে বনাঞ্চল ফাঁকা হয়ে পশুপাখির বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। “বন্যেরা বনে সুন্দর” প্রবাদ বাক্য মতে তাদেরকে আর বনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের চট্টগ্রাম, পার্বত্য জেলাগুলো ও দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, মোরগ, বুনোহাঁস এবং আরও অনেক প্রজাতির পশুপাখি ও সরীসৃপ আগের মতো দেখা যায় না। বন ধ্বংসের কারণে এসব প্রাণীরা আবাসস্থল হারিয়ে হত্যার শিকার হয়েছে কিংবা দূরে কোথাও পালিয়ে গেছে। ইদানীং খাবার সংগ্রহের লক্ষ্যে হাতির পাল লোকালয়ে প্রবেশ করে জমির ফসল এবং অন্যান্য সম্পদ নষ্ট করে থাকে।
কৃষির উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উপখাত হলো বন। জাতীয় অর্থনীতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু সহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৮ শতাংশ। জনসংখ্যার চাপে বনভূমির পরিমাণ ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে যারফলে আবহাওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বাতাস দূষিত হচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে মাটি। পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় অনাবৃষ্টি দেখা দিচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এবং বিলীন হচ্ছে অতুলনীয় সবুজ সৌন্দর্য। বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের কারণে বন ও বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। এজন্য আজকের বিশ্বের পরিবেশ ঝুঁকির সম্মুখীন। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্যমতে এখনই সময় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে পুনর্বিবেচনা করে সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়া। গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, উন্নয়ন কার্যক্রম, বৃক্ষ নিধন, বনজ সম্পদ আহরণসহ নানা কারণে বাংলাদেশেও বনভূমির পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ বন অধিদফতরের হিসাব মতে দেশের মোট ভূমির ১৭.৫ শতাংশ বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও প্রকৃত বন আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ আট ভাগের বেশি নয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট ৪ লাখ ১৬ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে যারমধ্যে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩১ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি জবর দখলের শিকার হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বনভূমি ধ্বংসের কারণে এরই মধ্যে বন্যপ্রাণীর ৩৯ টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরও প্রায় ৩৩ প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে রয়েছে। আইইউসিএনে বলা হয়েছে বৈরী জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশে ৬৩২ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি বিলুপ্ত হয়েছে এবং ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ৪৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে ৮টি এবং ১৬৭টি সরীসৃপ প্রাণীর মধ্যে ১৭টি বিলুপ্তির পথে। পাঁচ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১০৬টির অস্তিস্ত হুমকির মুখে।
সৃষ্টির শুরু থেকে অরণ্য ছিল মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। মানুষের আদি বাসস্থানও ছিল অরণ্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে নগর সভ্যতা গড়ে উঠার পর মানুষ অরণ্য কেন্দ্রিক বাসস্থান ছেড়ে শহর নগরে বসবাস করতে শুরু করেছে। উন্নয়নের বিজয় রথ যতই এগিয়ে চলেছে ততই সভ্যতা হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক। অরণ্য নিধন ও পরিবেশ দূষণের কারণে প্রতিনিয়ত পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ। বাঘ, হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা, বনরুই, উল্লুক, বনগরু, সাম্বার হরিণ, প্যারাইল্যা বানর, হিমালয়ান ডোরা কাঠবিড়ালি ও কালো ভল্লুক প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই শতকে মরিশাস থেকে হারিয়ে গেছে ডোডো নামের পাখি, আমেরিকার প্রেইরি বনভূমি থেকে হারিয়ে গেছে বাইসন, মেরু অঞ্চল হারিয়েছে স্বর্ণ শৃগাল।
প্রকৃতির অশান্ত বৈরী অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মানুষকে আবার কবিগুরুর কথায় বলতে হবে “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোস্ট ও প্রস্তর, হে নব সভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী; দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়া রাশি“। সবুজের অভিযান ও বৃক্ষায়ন কর্মসূচিকে বেগবান করতে মানুষকে সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে। বন ধ্বংস না হলে বন্যপ্রাণী রক্ষা পাবে। বন্যপ্রাণী যদি সকাল সন্ধ্যা শিকারীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে তখন তারা গভীর বনে আশ্রয় নেবে অথবা খাবার ও জীবন রক্ষার তাগিদে লোকালয়ে ঢুকে ফসল সম্পদ নষ্ট করবে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল সাইন্স পলিসি প্লাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি এন্ড ইকোসিস্টেম সার্বিসেজ‘র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী কয়েক দশক ধরে প্রায় ১ মিলিয়ন প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছে। আধুনিক নগর সভ্যতা অগ্রগতি এনে দিলেও কিন্তু মানুষ ক্রমেই হয়ে পড়েছে হৃদয়হীন নিষ্ঠুর। সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে মানুষকে অরণ্য রক্ষায় ব্রতী হতে হবে। জাতীয় অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের বন, বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, সমপ্রসারণ ও উন্নয়ন অতীব জরুরি। বন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি, সকল সংস্থা ও সাধারণ জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হচ্ছে সরকার মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে দেশের জনগণের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও গাছের চারা বিতরণ করে আসছে। বনায়ন কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে আমাদেরকে সড়ক–মহাসড়ক, নদীতীর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বসত বাড়ি ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে পর্যাপ্ত সংখ্যক গাছ লাগাতে হবে। প্রাণীর অস্তিত্ব ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে বনায়ন সৃজন ও বন সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। অনেক উন্নত প্রজাতির ফসল উদ্ভাবনের জন্য বন্য প্রজাতির ফসলের জিন সংগ্রহ করা হয়। প্রায় দুই হজার প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের জন্ম, উৎপত্তি, বাস ও নিরাপদ স্থান হচ্ছে বন। বন ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও যুগোপযোগী করতে যুক্ত হয়েছে সহব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। বন ও বন্যপ্রাণী বিপন্ন হলে বিপর্যস্ত হবে মানবসভ্যতা। সভ্যতার স্বার্থেই মানুষকে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।