বটতলী স্টেশনের সব ময়লা ফেলা হয় টংকাবতী খালে

পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ

মোহাম্মদ মারুফ, লোহাগাড়া | শনিবার , ৬ জুলাই, ২০২৪ at ৪:২৮ পূর্বাহ্ণ

লোহাগাড়া উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনের ময়লাআবর্জনা ফেলা হচ্ছে খালে। চট্টগ্রামকক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের রাজঘাটা ব্রিজ এলাকায় টংকাবতী খালে প্রতিদিন এই আবর্জনা ফেলা হয়। এতে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতাসহ দূষিত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ। সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে খালে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্তূপকৃত বর্জ্য ভাটিতে নেমে গেছে। এসব বর্জ্য সাঙ্গু নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।

জানা যায়, পার্বত্য বান্দরবান জেলার পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপত্তি হওয়া এই খালটি লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া, চরম্বা ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাতকানিয়ার গারাঙ্গিয়া এলাকায় ডলু খালে মিলিত হয়েছে। ডলু খাল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমের খোদারহাটের পাশ দিয়ে মিলিত হয়েছে সাঙ্গু নদীতে। স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে টংকাবতী খাল। শুষ্ক মৌসুমে টংকাবতী খালের তীরে জেগে উঠা প্রায় ২৮ হেক্টর চরে প্রায় ২ শতাধিক কৃষক শীতকালীন সবজির চাষাবাদ করেন। খালে বর্জ্য ফেলা অব্যাহত রাখা হলে এর প্রভাব সবজির উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্লাস্টিক ও পলিথিনসহ যত ধরনের ময়লাআবর্জনা আছে সব ফেলা হয় টংকাবতী খালে। বটতলী শহর উন্নয়ন কমিটির নির্দেশনা মতে প্রতিদিন গভীর রাতে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ভ্যান করে ওই স্থানে বর্জ্য ফেলেন। ক্ষতিকর বর্জ্য ফেলার কারণে একদিকে খালের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, অন্যদিকে বর্জ্যের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দা এবং মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াত করা পথচারী ও যাত্রীদের। এছাড়া দখলদূষণে বিপর্যস্ত খালটি অনেক স্থানে দেখে মনে হবে যেন সরু ছড়া।

গত বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, পানির ঢলের সাথে স্তূপ করা বর্জ্যের সিংহাভাগ চলে গেছে। এখনো বর্জ্যের স্তূপ খালের গতিপথ পর্যস্ত বিস্তৃত। এসব বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। স্তূপ থেকে চলে যাওয়া প্লাস্টিক ও পলিথিনের মতো কিছু কিছু বর্জ্য খালের ভাটির দিকে পাড়ের দুই পাশে গাছপালা এবং ঝোপঝাড়ে আটকে থাকতে দেখা গেছে।

স্থানীয় এহেতেশামুল হক রাব্বী জানান, স্তূপকৃত বর্জ্যের আশপাশে অনেক বসতি রয়েছে। প্রতিনিয়ত এসব বর্জ্য থেকে ছড়িয়ে পড়া দুর্গন্ধের কারণে মানুষের ঘরে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এছাড়া স্তূপকৃত বর্জ্য পানির স্রোতে নিচের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আশপাশের মানুষ যুগ যুগ ধরে টংকাবতী খালের পানি গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করে আসছে। তবে এখন বর্জ্যের কারণে পানি দূষিত হওয়ায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এছাড়া নির্বিচারে বালু উত্তোলন করায় খালটি বিপন্নপ্রায়। এর উপর এখন সেই মৃতপ্রায় খালে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। টংকাবতীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ ও স্তুপকৃত বর্জ্য সরিয়ে নিয়ে খালের প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

স্থানীয় বৃদ্ধ খাইরুল ইসলাম জানান, এক সময় টংকাবতী খালের পানি ছিল একেবারে স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ পানিতে জাল ফেললেই কই, পুঁটি, মলা, বাইম, মাগুর, শিং, টেংরা, টাকি, বাইলা, শোল ও বোয়ালসহ নানা প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আগের মতো সেই স্বচ্ছ পানিও নেই, মাছও নেই। কালের পরিবর্তনে টংকাবতী এখন মৃতপ্রায়।

স্থানীয় পরিবেশ কর্মী সানজিদা রহমান জানান, গত ৩ মে আমিরাবাদ রাজঘাটা এলাকায় টংকাবতী খাল রক্ষায় দখল ও দূষণমুক্ত করতে এক মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেননি। টংকাবতী খালে ফেলা পলিথিন ও প্লাস্টিকের মতো নানা ক্ষতিকর অপচনশীল বর্জ্য জলজ প্রাণীর বংশবিস্তারে বাধাগ্রস্ত করছে। এসব বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। এছাড়া আশপাশের মানুষ শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। খালে যারা বর্জ্য ফেলছে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

লোহাগাড়া বটতলী শহর উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক মো. সালাহ উদ্দিন হিরু জানান, তৎকালীন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল আমিরাবাদ রাজঘাটা এলাকায় টংকাবতী খালের পাড়ে বটতলী স্টেশনের ময়লাআবর্জনা ফেলার জন্য ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করেন। কিন্তু সেখানে ফেলা আবর্জনা রিসাইক্লিং করার ব্যবস্থা না থাকায় দিন দিন স্তূপ বড় হয়ে খালের মধ্যে পড়েছে। বর্জ্যের কারণে খাল ও পরিবেশ দূষিত হওয়া কোনভাবে কাম্য নই। আগামী ১০ জুলাই উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় এই বিষয় নিয়ে জোরালো ভাবে আলোচনা করা হবে। আশা করছি বটতলী স্টেশনের ময়লাআবর্জনা নিরাপদ স্থানে ফেলার জন্য স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে।

এদিকে, গত ১ জুলাই টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে টংকাবতী খালে পানি বৃদ্ধি ফেলে বর্জ্যের স্তূপের কারণে স্বাভাবিক গতিতে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইনামুল হাছান। তবে, টংকাবতী খালে ময়লার স্তূপের কারণে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ আশপাশের পরিবেশ দূষিত হওয়ার ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে কিনা জানতে ইউএনওকে একাধিবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই এই ব্যাপারে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশত শত শিক্ষার্থীকে টপকে জয়ী মহেশখালীর ৭ খুদে বিজ্ঞানী
পরবর্তী নিবন্ধখবরদারি কমিয়েছে পদ্মা সেতু, মর্যাদার আসনে বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী