২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর। আগ্রাবাদে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ১৯ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনপূর্ব অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি বলেছিলেন, ‘অটোমেশন হলে তেল চুরি বন্ধ হয়ে যাবে। তেল চুরি বন্ধ হলে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।’ ওইদিন তিনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আজকে বলে যাচ্ছি, আগামি তিন মাসের মধ্যে কনসালটেশনের মাধ্যমে অটোমেশনের কাজ শুরু করতে হবে।’ মন্ত্রীর নির্দেশনার সেই তিন মাসের স্থলে এখন প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেছে। মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার তেলও চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেল খালাস ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন কার্যক্রমের ফিজিবিলিটি স্টাডিও শুরু করতে পারেনি বিপিসি। বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিড শুরু হওয়ায় বিদেশি বিশেষজ্ঞরা আসতে পারেননি। তাই ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে।
বিপিসি সূত্র জানায়, পতেঙ্গায় পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির প্রধান স্থাপনায় তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় অটোমেশনের আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০১৯ সালে “ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর অটোমেশন অব মেইন ইনস্টলেশনস অব থ্রি অয়েল কোম্পানিজ অ্যাট পতেঙ্গা, চিটাগাং, বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিপিসি। ইতোমধ্যে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র (ইওআই) আহবান করা হয়। ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর বিপিসির বোর্ড সভায় ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য দরপত্রে সর্বোচ্চ স্কোরার হিসেবে স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান ‘টেকনিকাস রিউনিডাস’ কে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
সূত্র জানায়, দেশে বছরে পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬৬ লাখ মেট্রিক টন। পদ্মা মেঘনা যমুনা অয়েল এসব জ্বালানি পণ্য বিপণন করে থাকে। জ্বালানি তেল মজুদ ও সরবরাহের জন্য পতেঙ্গায় পদ্মা অয়েলের প্রধান স্থাপনায় ১ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ৫৭টি স্টোরেজ রয়েছে। প্রধান স্থাপনা থেকে পদ্মা অয়েল বার্ষিক ২৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি সারাদেশে সরবরাহ করে। একইভাবে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান স্থাপনায় ১ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ৩৪টি স্টোরেজ ট্যাংক রয়েছে। তাতে বছরে ২৮ লাখ ৫০ হাজার টন জ্বালানি সারাদেশে সরবরাহ করে। অন্যদিকে যমুনা অয়েলের প্রধান স্থাপনায় ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ১৯টি স্টোরেজ ট্যাংক রয়েছে। প্রধান স্থাপনা থেকে যমুনা অয়েল বছরে ১৭ লাখ মেট্রিক টন পেট্রোলিয়াম পণ্য দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করে। তিন বিতরণ কোম্পানির পুরো অপারেশনাল কার্যক্রম চলে ম্যানুয়াল (সনাতন) পদ্ধতিতে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইমপোর্ট ট্যাংকার এবং রিফাইনারি হতে পেট্রোলিয়াম পণ্য গ্রহণ, ট্যাংক ট্রাক ইনভয়েজিং-লোডিং-আনলোডিং, ট্যাংক ওয়াগন লোডিং-আনলোডিং, কোস্টাল ট্যাংকার ইনভয়েজিং-লোডিং-আনলোডিং, ট্যাংক ফার্ম ব্যবস্থাপনা, পাম্প হাউজ পরিচালনা, ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম পরিচালনা, ব্যবস্থাপনার নানা তথ্য সরবরাহ এবং ইআরপি ইন্টারপেস এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে।
এ ব্যাপারে বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রকৌশলী মো. রাশেদ কাউছার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জ্বালানি বিতরণ ব্যবস্থাকে অটোমেশনের আওতায় আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া চুড়ান্ত হয়েছে। তবে কোভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে বিদেশি কনসালটেন্টরা আসতে না পারার কারণে কার্যক্রম কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘জ্বালানি তেল বিপণনে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার তেল চুরি হয়। সিস্টেম লসের নামেও তেল চুরি হয়। অথচ অটোমেশন হলে সিস্টেম লস কমে আসবে। তেল চুরিও কমে যাবে। প্রধান স্থাপনাসহ ডিপোগুলো অটোমেশনের আওতায় আসলে জ্বালানি তেল চুরির সুযোগ থাকবে না। তবে নানাভাবে অটোমেশন কার্যক্রম ব্যাহত করার পাঁয়তারা চলছে। প্রভাবশালী লোকজন ও বিপণন কোম্পানিগুলোর একটি অংশ অটোমেশনের বিপক্ষে। যে কারণে অটোমেশন কার্যক্রম আলোর মুখ দেখছে না।’












