বঙ্গবন্ধুর শিশুপ্রীতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ২১ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

১৭ মার্চ ১৯৬৭। সেদিন ছিল শুক্রবার। কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচা’য় লেখেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এইদিনে ১৯২০ সালে পূর্ববাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই- বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটিতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে।’
শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শিশুরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নিজেদের জীবনকে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে আলোকিত করার শপথ গ্রহণ করে।
শিশুরাই আগামী প্রজন্ম। তারা গড়ে উঠুক কল্যাণকামী ও সৌন্দর্যমূলক জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। এই স্বপ্ন আমাদের চেতনায় জাগিয়ে দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর শিশুপুত্র রাসেল ছিল বাংলাদেশের সব শিশুদের প্রতীক। তিনি অনুধাবন করেছেন শিশুর কাছে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদেরও গড়তে হবে। ওদের ভেতরে দেশপ্রেম জাগাতে হবে। এ লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য এবং জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে করেন বাধ্যতামূলক।
১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে করা হয় জাতীয়করণ। শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন প্রণয়ন করেন। এর ১৫ বছর পর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ তৈরি করে। বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদের অন্যতম অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। গ্রহণ করা হয়েছে জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শিশু নীতিকে আরো যুগোপযোগী করতে ঘোষিত হয় শিশু আইন ২০১৩। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। পরিত্যক্ত শিশুদের সেবা ও ভাতা প্রদান, পথশিশুদের পুনর্বাসনসহ তাদের জীবনমান উন্নত করতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিশু শিক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে স্কুল টিফিন, শিশুর জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে করা হয়েছে জনকল্যাণমুখী।
শিশুর দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগপরবর্তী সময়ে সকল শিশুর সুরক্ষা এ সকল কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য। মেয়েশিশুর প্রতি বৈষম্য দূর করা এবং তাদের শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠীরূপে গড়ে তুলতে ছাত্রী উপবৃত্তি প্রদানসহ নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী এবং অটিস্টিক শিশুদের উন্নয়নের জন্যও রয়েছে নানান কর্মসূচি ও পরিকল্পনা। সকল শিশুর জন্য সমসুযোগ ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে জাতির সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলাই এসব প্রচেষ্টার প্রধান লক্ষ্য। বিশেষ করে গ্রামের মেয়েশিশুদের এগিয়ে চলার বড় বাধা বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিচালিত বর্তমান সরকার শিশুবান্ধব সরকার। সরকারের শিশুবান্ধব পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বাস্তব রূপকার মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এ দেশের শিশুদের সাংস্কৃতিক শিশু হিসেবে গড়ে তুলতে বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি- শিশু বিষয়ক একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। শিশুদের প্রত্যক্ষ পরিচর্যা ও সাহচর্যের একেকটি সুন্দর মানবিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে দেশের প্রতিটি শিশু একাডেমি শাখা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শিশুদের প্রিয় বন্ধু। বড়োদের মতো শিশু-কিশোরদের কাছেও তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাই’। ১৯৬৩ সালের কথা। ঢাকা প্রেস ক্লাবে আয়োজন করা হয় দশ দিনব্যাপী শিশুমেলা। ওই শিশুমেলায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’
নিজের শৈশবকালটা বর্ণাঢ্য রেখেছিলেন মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অধিকার সচেতন। বেড়ে উঠেছেন মানবিক গুণাবলি নিয়ে। তাঁর অন্তর ছিল মমতামাখা। তাঁর আন্তরিক ভালোবাসায় দেশের শিশু সংগঠনগুলো হয়েছে বর্ণিল। কচিকাঁচার মেলার মার্চপাস্টে সালাম গ্রহণ করেছেন। খেলাঘরের ভাই-বোনদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। শিশুদের সঙ্গে তিনি সব সময় থাকতেন হাস্যোজ্জ্বল। শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর দুয়ার ছিল খোলা।
১৯৭২-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। সে সময়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধায়’ যান। সঙ্গে ছিলেন ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন ও লুৎফুল হায়দার চৌধুরী। শিশুদের আঁকা ছবিগুলো বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটুখানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’
অন্য একটি ঘটনা। ১৯৭২-এর এক সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন, যেমনটি রোজ বের হন। সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। তিনি হঠাৎ দেখলেন একটি ছোট ছেলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কাছে ডাকার পর ছেলেটি জানায় যে, তার পা ব্যথা করছে বলে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু নিজে ছেলেটির জুতা খুলে দেখেন যে, জুতার মধ্যে একটি পেরেকের সুঁচালো মাথা বেরিয়ে আছে, যার খোঁচায় ছেলেটির পা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই চিকিৎসার জন্য তাঁর দেহ রক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিলেন, তার হাতে কিছু টাকাও দিলেন। আর পরম মমতায় ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন।

শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিসীম দরদ। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজ, মানুষ আর মানুষের রাজনীতির মধ্যে যত বিভেদই তৈরি হোক না কেন, প্রতিটি শিশুকে সাম্য ও সমতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। শিশুদের প্রাণে জাগাতে হবে অসামপ্রদায়িক চেতনা। সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে নতুন থেকে নতুনের দিকে এগিয়ে চলার যে শিক্ষা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক, সেই শিক্ষাই ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন শিশুর অন্তরে। আজকের শিশুরা একদিন সাম্য ও সমতার বিশ্ব নির্মাণে হয়ে উঠবে আগামী দিনের নেতৃত্বদানকারী।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম শক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা আজকের শিশু-কিশোর। দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠা, তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কিত পরিপূর্ণ জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে আজকের শিশু-কিশোরদের চিনতে হবে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে চেনা মানেই বাংলাদেশকে চেনা। শিশুদের সত্যকে জানতে হবে। মানবিক হতে হবে। উদার হতে হবে। এসব গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশকে ভালোবাসতে হবে। বড়োদের কাছ থেকেই শিশুরা নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের কথা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ