বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্রচিন্তা

ড. মো. মোরশেদুল আলম | রবিবার , ৬ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

চলচ্চিত্র নির্মাণের দর্শক, নির্মাতা ও নির্মাণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সেই সময়ের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু)-এর নির্দেশে মাত্র দু’দিনের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল খায়ের এবং প্রাদেশিক চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান নজীর আহমেদ EPFDC বিলের খসড়া তৈরি করেন। তখন চলচ্চিত্র নির্মাতারা ফিল্ম স্টুডিও নির্মাণের ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল The East Pakistan Film Development Corporatrion Bill-1957 তদান্তীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপন করেন। সামান্য সংশোধনী শেষে ঐ অধিবেশনেই বিনা আপত্তিতে বিলটি সেদিন পাস হয়। এভাবেই EPFDC Act XV of 1957 প্রণীত হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয় EPFDC; যা আজকের বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন। আইন পরিষদে বিল পাশের মাধ্যমে সরকারিভাবে এ ধরনের চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের জন্ম ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস উদযাপন করে। বঙ্গবন্ধুর FDC প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এবং আবুল খায়ের ও নজীর আহমদের সংগঠনিক দক্ষতায় এর কার্যক্রম শুরু হয়। এভাবেই ঢাকায় চলচ্চিত্র শিল্পের শক্ত বুনিয়াদ গড়ে ওঠে। ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ৭ একর জমির উপর এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হয়। নয়টি শুটিং ফ্লোর, মুভি ক্যামেরা, লাইটিং সিস্টেম, উন্নত প্রযুক্তি, সম্পাদনার যন্ত্রপাতি, সাউন্ড কমপ্লেক্স ও আনুষঙ্গিক শুটিং সুবিধাদি এফডিসিকে ঢাকার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আশ্রায়স্থলে পরিণত করে। চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র সমালোচক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,

চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত ও অপরিমেয় শক্তির কথা জানতেন আমাদের স্বাধীনতার মহান রূপকার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাই তিনি সেদিন চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশের সম্ভাবনার বীজ রোপণ করেছিলেন এফডিসি প্রতিষ্ঠার বিল উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। এফডিসি প্রতিষ্ঠার ফলে ১৯৫৯ সাল থেকে ঢাকার দর্শকরা নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পায়, শুরু হয় ঢাকার নতুন চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা।

এ দেশের সর্বপ্রথম শিল্পিত চলচ্চিত্রের সূচনা করলেন উদীয়মান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তাঁর কখনো আসেনি (১৯৬১) চলচ্চিত্র দিয়ে। ফতেহ্‌ লোহানী নির্মিত আসিয়া (১৯৬০) চলচ্চিত্রটি গ্রামবাংলার আলেখ্য নিয়ে তৈরি। তবে সত্যিকার অর্থে নিটোল চলচ্চিত্র প্রচেষ্টা হলো জহির রায়হানের কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩)। সালাহউদ্দীনের সূর্যস্নান (১৯৬২) চলচ্চিত্র ছিল আলাউদ্দিন আল আজাদের শ্রেণিসংগ্রাম ভিত্তিক গল্প নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের চলচ্চিত্র শিল্পীদের সামাজিক মর্যাদার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। সমকালীন বৈচিত্র্যময় ও মনকাড়া গল্পের অনেক শিল্পী স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য এগিয়ে আসেন এবং চলচ্চিত্রে অভিনয় অনেকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এই পর্বে পেশাদার চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা অভিনেত্রী ও কলাকুশলীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের পথ দ্রুত প্রশস্ত হয়। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে স্বাধীনতা পূর্বকালে এ দেশের চলচ্চিত্র সার্বিক পরিপূর্ণতা লাভের দিকে এগুতে থাকে।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শহিদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও চলচ্চিত্র শিল্প নানা আলোকে উদ্ভাসিত। এ সময় বাড়তে থাকে নতুন চলচ্চিত্রের সংখ্যা। নির্মিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র, অসাম্প্রদায়িক চেতনার চলচ্চিত্র। পুনর্গঠিত হয় এফডিসি, সেন্সর বোর্ড, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, বিটিভি, সংযোজিত হয় সেন্সর নীতিমালা, গঠিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, প্রচেষ্টা চলে ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার, বিদেশে পেরিত হয় চিত্র প্রতিনিধি দল, বিদেশি মেলায় ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, দেশে অনুষ্ঠিত হয় বিদেশি চিত্র মেলা, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়, নতুন প্রযোজকপরিচালকশিল্পীকুশলীরা এই পেশায় এগিয়ে আসেন।

বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩১৯৭৮) চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য ৪ কোটি ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বরাদ্দকৃত অর্থ ফিল্ম স্টুডিও’র সম্প্রসারণ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে নতুন ফিল্ম স্টুডিও স্থাপন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং সারা দেশে ১০০টি নতুন সিনেমা হল নির্মাণ এবং এর ফলে দেশে ৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। এই উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জনের জন্য তৎকালীন তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রীকে ভারতের পূনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। ওই সময় বেসরকারি পর্যায়ে আলমগীর কবিরের উদ্যোগে ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট চালু হয়। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগে একটি চলচ্চিত্র সমীক্ষণ কোর্স চালু হয়। পূনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সতীশ বাহাদুর ওই কোর্স পরিচালনা করেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভএর রূপরেখাও তৈরি করে দেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে চলচ্চিত্র, অভিনয় ও অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানো হয়। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশ ও চর্চার ক্ষেত্রে নবজোয়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে ১৪/১৫টি চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের ১৮ মে থেকে ২৪ মে ঢাকায় পোল্যান্ড চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে এসেজ এন্ড ডায়মন্ড, প্যাসেঞ্জার, দি ডল, দি গেম, দি কার্ডিওগ্রাম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। ১৯৭৪ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব অনষ্ঠিত হয়। এ উৎসবে অশনি সংকেত, নিমন্ত্রণ, স্ত্রীর পত্র, সুবর্ণ রেখা, উপহার, স্বয়ম্ভবম ও মাটির মনিষা চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলে বিদেশে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র মেলা অনুষ্ঠিত হয়, প্রেরিত হয় প্রতিনিধি দল এবং পায় পুরস্কার প্রশংসাও। ১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড পুরস্কার পায়। এটি পরে ‘সিডালক’ পুরস্কারও পায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে অসুস্থ শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি সেবীদের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ তহবিল’ গঠন করেন। এর জন্য ৫টি বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এগুলো হলো: অপুর সংসার, দীপ জেলে যাই, কাবুলিওয়ালা, পৃথিবী আমারে চায় ও সাধারণ মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়। বিভিন্ন চলচ্চিত্র রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছিল ১৯৭২১৯৭৩ সালে ২০০০ মার্কিন ডলার, ১৯৭৩১৯৭৪ সালে ১১০০০ মার্কিন ডলার এবং ১৯৭৪১৯৭৫ সালে ৫০০০ মার্কিন ডলার। বঙ্গবন্ধুর আমলে বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রবর্তিত সেন্সর আইন ও বিধি সংশোধন করা হয়। এগুলো হলো: ) বাংলাদেশ সিনেমাটোগ্রাফ রুলস, ১৯৭২ এবং খ) দি সেন্সরশিপ অব ফিল্মস এ্যাক্ট, ১৯৬৩ এ্যাক্ট নং ১৮ (১৯৬৩), পিও নং ৪১/১৯৭২ ধারা সংশোধিত। সেন্সরশিপ আইন অনুসারে নতুন সেন্সর বোর্ড গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যস্ততম রাজনৈতিক কর্মজীবনের অবসরে বাংলাদেশে নির্মিত রূপবান এবং নবাব সিরাজদ্দৌলা চলচ্চিত্র দেখেছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম সূত্রে জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগ্রাম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই চলচ্চিত্রকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ ঘোষণা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা প্রদান এবং বিদ্যুৎ বিল গ্রহণে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। মাল্টিপ্লেক্স নির্মাতাদের ৫ বছরের কর রেয়াদ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশনে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট আইন২০১৩’ গৃহীত হওয়ার পর তথ্য মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মন প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণের যে সুযোগ রয়েছে, তাকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের সবাইকে আমি এ আহ্বান জানাব, আমাদের স্বাধীনতা অর্জন, গণমানুষের যে আত্মত্যাগ এবং আমাদের এগিয়ে চলার পথটা যেন মানুষের সামনে আরো ভালোভাবে উপস্থাপন করা হয়।

লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রসাহিত্যে বর্ষা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে