বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা

ড. সেলিনা আখতার | রবিবার , ২৭ আগস্ট, ২০২৩ at ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। অসামান্য নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধামমত্ববোধ, সততা এবং দেশ প্রেমের প্রজ্বলিত এক উজ্জ্বল অগ্নিশিখা তিনি। মৃত্যুকে পরোয়া না করে তিনি গোটা বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। পাকিস্তান দের শোষণের হাত থেকে একটি জাতিকে মুক্ত করে ‘বাংলাদেশ’ নামের এক নতুন সূর্যের উদয় করেছিলেন তিনি। বাঙালীর আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এদেশের দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে সপেঁঁ দিয়েছেন। তাঁর উন্নয়ন ভাবনায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে। তিনি ১৯৬৬ সালের ‘ছয়দফা’কে বাঙালির ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে মুক্তি পাগল বাঙালীর কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। ওই ছয়দফার ভেতরেই বাঙালীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ তিনি বুনেছিলেন। আর সে কারণেই জেলে বন্দী থাকলেও ছয়দফার মূল কথাগুলো দাবানলের মতো সারা বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। ঢাকার তেজগাঁও থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পথ তাঁকে প্রায় ৫ ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের বিজয় দিবস। এ দিন সকালবেলা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পূর্ব পাকিস্তান শাখায় রক্ষিত সব টাকা পুড়িয়ে দেয়। স্বর্ণ এবং অন্যান্য মূল্যবান রত্ন ও দলিলদস্তাবেজ পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বেই সরিয়ে ফেলেছিল। তারা এদেশকে ধ্বংস করার জন্য পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করেছিল। এমন একটা শূন্য অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে আসার ২০ দিনের মাথায় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি সর্বপ্রথম যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন, সেটি হলো বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন। শুধু পরিকল্পনা কমিশন নয়, মাত্র দশ মাস সময়ের মধ্যেই তিনি একটি সংবিধানও প্রণয়ন করেন এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি তা সই করেন। এই সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বিাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এই পাঁচটি মৌলিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। একটি উদার ও অসাম্প্রদায়িক সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সংখ্যালঘু সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন১৯৭২ প্রণয়ন করেন। বিজয় অর্জনের তিন মাসের মধ্যে ১২ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনী, যারা আমাদের মিত্রবাহিনী ছিল তাদের ফেরত যাওয়া নিশ্চিত করেন।

১৯৭২ সালের ১ লা নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ; ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা; ১৯৭৩ সালের ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা; ১৯৭৩ সালে ১৫নং রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে জাতীয় আণবিক শক্তি কমিশনের যাত্রা; ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে শিল্প বিনিয়োগ নীতিমালা ঘোষণা; ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা; এবং ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংস প্রাপ্ত কৃষিঅবকাঠামো পুনর্র্নিমাণ করা এ সবই জাতির পিতা অত্যন্ত সুদৃঢ় ভাবে সম্পন্ন করেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরদিনের জন্য রহিত করেন। শক্তি চালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১১ হাজার থেকে ৩৬ হাজারে উন্নীত করেন। বিশ্ববাজারে সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষককে রক্ষা করেন। কৃষকদের সততা ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল স্বচ্ছ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। ১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। বঙ্গবন্ধুর সচেতন ও কৃষকদরদী নীতির ফলে কৃষিতে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষি খাত শক্তিশালী হয়েছে।

বাংলাদেশে নয় মাস গণহত্যার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত এই মতৃভূমির দায়িত্ব নেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধোত্তর দেশে ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মকান্ড হাতে নেন তিনি। এজন্য সব পর্যায়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২ সাল জুড়ে দেশে অনেক যুদ্ধ শিশুর জন্ম হয়। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশুদের গ্রহণে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় যুদ্ধ শিশুদের বিদেশে দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আইনের। এই সমস্যা সমাধানে তিনি ১৯৭২ সালে ইধহমষধফবংয অনধহফড়হবফ ঈযরষফৎবহ (ঝঢ়বপরধষ চৎড়ারংরড়হং) ঙৎফবৎ, ১৯৭২ জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে বহু শিশুকে বিদেশে দত্তক দেয়া হয়। যে সব শিশুকে দত্তক দেয় যায়নি তাদেরকে বিভিন্ন শিশু সদনে পুর্নবাসন করা হয়। গৃহহীনদের আবাসন সুবিধা, জরুরী ভিত্তিতে নগদ টাকা, খাদ্য সহায়তা, শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে আর্থিক সহায়তা, মহকুমা সদরে অভিভাবকহীন নারীদের আশ্রয় প্রদান, নির্যাতিত মাবোনদের পুনর্বাসন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, শরণার্থী পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফেরত আনা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে পাকিস্তানী বাহিনীর দোসরদের রাহুমুক্ত করে পুনর্গঠন, যুদ্ধাপরাধী বন্দিদের বিচার, উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর প্রত্যর্পণ, পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুজ্জীবন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা, খাদ্য ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে প্রভৃতি পেশার মানুষদের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা দেওয়া হয় যাতে তারা নিজ নিজ পেশা অব্যাহত রাখতে পারেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমাদান, যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্তীকরণ, সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, অন্যদিকে ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা, বিমানবাহিনীর জন্য বারোটি মিগ২১ যুদ্ধবিমান, রাডার, এ এন২৪ ও ২৬ বিমান, এম আই৮ হেলিকপ্টার বিমানবাহিনীর জন্য সংগ্রহ করেন।

জাতির পিতা ১৯৬৬ সালে প্রদত্ত ছয় দফায় তৎকালীন পূর্ব বাংলায় নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপনের দাবি জানিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি তিনটি নৌঘাঁটি স্থাপন ও অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ যুক্ত করেন।

বঙ্গবন্ধু দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করেন। উৎপাদন সচল রাখার জন্য থোক বরাদ্দ প্রদান এবং কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত ও খাতভিত্তিক শিল্প কারখানার পুনরুজ্জীবন ঘটান। জাতির পিতার অন্যান্য অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো হলো বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা; মুদ্রা প্রবর্তন, মুদ্রাম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আমদানিরপ্তানি চালু, জনবান্ধব বাজেট প্রণয়ন; শিল্প কারখানা জাতীয়করণের মাধ্যমে শিল্পায়ন; পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন; মাথাপিছু আয় ২ দশমিক ৫ ভাগ বৃদ্ধি করণ। তিনি সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপস্তক প্রদান করেন; যুদ্ধকালীন বকেয়া ফি মওকুফ করেন এবং দুই শিফটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় গোডাউনে যত খাদ্য ছিল সব পাকিস্তানি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কৃষি উৎপাদন সম্ভব ছিল না। ধান যেটুকু হয়েছিল তাও কাটা সম্ভব হয়নি। ভারতে প্রায় এক কোটি লোক স্থানান্তরিত হয়েছিল। কৃষি একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে সময়ে দেশে ভূমির আকার এবং মাথাপিছু বা পরিবার প্রতি জমির পরিমাণ খুবই কম ছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের দেওয়া সব সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করে নিলেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। পাট গবেষণাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য জুট স্টাডি সেন্টারকে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে পরিণত করেন। তুলা উন্নয়ন বোর্ড; ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আনবিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র; বিএডিসি ও বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রথম পুলিশ সপ্তাহের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ীএই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন? মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন? গরিবের ওপর অত্যাচার করলে আল্লাহ্‌র কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই, শুধু আপনাদেকেই নয়, সমস্ত সরকারি কর্মচারিকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। ’ ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু নানা বক্তৃতায় বারবার সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কথা, মান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার মৌলিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও ক্ষুধাদারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীর এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমি কি চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কি চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন পূরণের পথেই হাঁটছে আজকের আমাদের এই বাংলাদেশ।

সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সোনার বাংলাদেশ গড়ার অভীষ্ট লক্ষ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১এর কালরাতে পাকিস্তানী বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হলে গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরপর প্রহসনের বিচারে পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁকে ফাঁসির দন্ডাদেশ দেয় সামরিক জান্তা সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রবল চাপে এ দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন জাতির পিতা। পূর্ণতা পায় আমাদের বিজয়ের আনন্দ।

স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে দেশ পুনর্গঠনে যখন তিনি গভীরভাবে নিমগ্ন, মোকাবিলা করছেন নানামুখী সংকট ও ষড়যন্ত্র, সে মুহূর্তেই ঘাতকের বুলেটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের আঠারো সদস্য। ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের যেন সুষ্ঠু বিচার না হয় সেজন্য প্রণীত হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক কালো আইন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। এ হত্যাকান্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি গ্লানিমুক্ত হয়। জাতির পিতা আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তিনি অমর, অবিনশ্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে তিনি চিরজাগ্রত। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। তাঁর আদর্শ চিরঅম্লান। তাঁর অর্থনৈতিক ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, দেশের প্রত্যেকটি নাগরিককে প্রকৃত দেশপ্রেমিক, সৎ, নিষ্ঠাবান, সাহসী ও ত্যাগী দেশকর্মী হওয়া উচিত। তাঁর সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোটা জাতিকে উন্নত করতে একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সত্যিকারের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা’, যেমনটি বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে তাঁরই সুযোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পূরো বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময় এবং উন্নয়নের রোল মডেল । বঙ্গবন্ধু কন্যা ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ অর্জন করার জন্য কাজ করছি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুতেই বংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সব কিছুই বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা থেকে উৎসারিত এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে বিনির্মিত। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, রাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

প্রফেসর ড. সেলিনা আখতার : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, রাঙ্গামাটি বিঞ্জান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা

. সেলিনা আখতার

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। অসামান্য নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধামমত্ববোধ, সততা এবং দেশ প্রেমের প্রজ্বলিত এক উজ্জ্বল অগ্নিশিখা তিনি। মৃত্যুকে পরোয়া না করে তিনি গোটা বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। পাকিস্তান দের শোষণের হাত থেকে একটি জাতিকে মুক্ত করে ‘বাংলাদেশ’ নামের এক নতুন সূর্যের উদয় করেছিলেন তিনি। বাঙালীর আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এদেশের দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে সপেঁঁ দিয়েছেন। তাঁর উন্নয়ন ভাবনায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে। তিনি ১৯৬৬ সালের ‘ছয়দফা’কে বাঙালির ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে মুক্তি পাগল বাঙালীর কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। ওই ছয়দফার ভেতরেই বাঙালীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ তিনি বুনেছিলেন। আর সে কারণেই জেলে বন্দী থাকলেও ছয়দফার মূল কথাগুলো দাবানলের মতো সারা বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। ঢাকার তেজগাঁও থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পথ তাঁকে প্রায় ৫ ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের বিজয় দিবস। এ দিন সকালবেলা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পূর্ব পাকিস্তান শাখায় রক্ষিত সব টাকা পুড়িয়ে দেয়। স্বর্ণ এবং অন্যান্য মূল্যবান রত্ন ও দলিলদস্তাবেজ পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বেই সরিয়ে ফেলেছিল। তারা এদেশকে ধ্বংস করার জন্য পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করেছিল। এমন একটা শূন্য অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে আসার ২০ দিনের মাথায় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি সর্বপ্রথম যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন, সেটি হলো বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন। শুধু পরিকল্পনা কমিশন নয়, মাত্র দশ মাস সময়ের মধ্যেই তিনি একটি সংবিধানও প্রণয়ন করেন এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি তা সই করেন। এই সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বিাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এই পাঁচটি মৌলিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। একটি উদার ও অসাম্প্রদায়িক সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সংখ্যালঘু সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন১৯৭২ প্রণয়ন করেন। বিজয় অর্জনের তিন মাসের মধ্যে ১২ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনী, যারা আমাদের মিত্রবাহিনী ছিল তাদের ফেরত যাওয়া নিশ্চিত করেন।

১৯৭২ সালের ১ লা নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ; ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা; ১৯৭৩ সালের ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা; ১৯৭৩ সালে ১৫নং রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে জাতীয় আণবিক শক্তি কমিশনের যাত্রা; ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে শিল্প বিনিয়োগ নীতিমালা ঘোষণা; ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা; এবং ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংস প্রাপ্ত কৃষিঅবকাঠামো পুনর্র্নিমাণ করা এ সবই জাতির পিতা অত্যন্ত সুদৃঢ় ভাবে সম্পন্ন করেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরদিনের জন্য রহিত করেন। শক্তি চালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১১ হাজার থেকে ৩৬ হাজারে উন্নীত করেন। বিশ্ববাজারে সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষককে রক্ষা করেন। কৃষকদের সততা ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল স্বচ্ছ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। ১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। বঙ্গবন্ধুর সচেতন ও কৃষকদরদী নীতির ফলে কৃষিতে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষি খাত শক্তিশালী হয়েছে।

বাংলাদেশে নয় মাস গণহত্যার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত এই মতৃভূমির দায়িত্ব নেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধোত্তর দেশে ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মকান্ড হাতে নেন তিনি। এজন্য সব পর্যায়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২ সাল জুড়ে দেশে অনেক যুদ্ধ শিশুর জন্ম হয়। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশুদের গ্রহণে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় যুদ্ধ শিশুদের বিদেশে দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আইনের। এই সমস্যা সমাধানে তিনি ১৯৭২ সালে ইধহমষধফবংয অনধহফড়হবফ ঈযরষফৎবহ (ঝঢ়বপরধষ চৎড়ারংরড়হং) ঙৎফবৎ, ১৯৭২ জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে বহু শিশুকে বিদেশে দত্তক দেয়া হয়। যে সব শিশুকে দত্তক দেয় যায়নি তাদেরকে বিভিন্ন শিশু সদনে পুর্নবাসন করা হয়। গৃহহীনদের আবাসন সুবিধা, জরুরী ভিত্তিতে নগদ টাকা, খাদ্য সহায়তা, শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে আর্থিক সহায়তা, মহকুমা সদরে অভিভাবকহীন নারীদের আশ্রয় প্রদান, নির্যাতিত মাবোনদের পুনর্বাসন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, শরণার্থী পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফেরত আনা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে পাকিস্তানী বাহিনীর দোসরদের রাহুমুক্ত করে পুনর্গঠন, যুদ্ধাপরাধী বন্দিদের বিচার, উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর প্রত্যর্পণ, পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুজ্জীবন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা, খাদ্য ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে প্রভৃতি পেশার মানুষদের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা দেওয়া হয় যাতে তারা নিজ নিজ পেশা অব্যাহত রাখতে পারেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমাদান, যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্তীকরণ, সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, অন্যদিকে ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা, বিমানবাহিনীর জন্য বারোটি মিগ২১ যুদ্ধবিমান, রাডার, এ এন২৪ ও ২৬ বিমান, এম আই৮ হেলিকপ্টার বিমানবাহিনীর জন্য সংগ্রহ করেন।

জাতির পিতা ১৯৬৬ সালে প্রদত্ত ছয় দফায় তৎকালীন পূর্ব বাংলায় নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপনের দাবি জানিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি তিনটি নৌঘাঁটি স্থাপন ও অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ যুক্ত করেন।

বঙ্গবন্ধু দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করেন। উৎপাদন সচল রাখার জন্য থোক বরাদ্দ প্রদান এবং কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত ও খাতভিত্তিক শিল্প কারখানার পুনরুজ্জীবন ঘটান। জাতির পিতার অন্যান্য অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো হলো বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা; মুদ্রা প্রবর্তন, মুদ্রাম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আমদানিরপ্তানি চালু, জনবান্ধব বাজেট প্রণয়ন; শিল্প কারখানা জাতীয়করণের মাধ্যমে শিল্পায়ন; পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন; মাথাপিছু আয় ২ দশমিক ৫ ভাগ বৃদ্ধি করণ। তিনি সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপস্তক প্রদান করেন; যুদ্ধকালীন বকেয়া ফি মওকুফ করেন এবং দুই শিফটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় গোডাউনে যত খাদ্য ছিল সব পাকিস্তানি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কৃষি উৎপাদন সম্ভব ছিল না। ধান যেটুকু হয়েছিল তাও কাটা সম্ভব হয়নি। ভারতে প্রায় এক কোটি লোক স্থানান্তরিত হয়েছিল। কৃষি একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে সময়ে দেশে ভূমির আকার এবং মাথাপিছু বা পরিবার প্রতি জমির পরিমাণ খুবই কম ছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের দেওয়া সব সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করে নিলেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। পাট গবেষণাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য জুট স্টাডি সেন্টারকে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে পরিণত করেন। তুলা উন্নয়ন বোর্ড; ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আনবিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র; বিএডিসি ও বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রথম পুলিশ সপ্তাহের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ীএই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন? মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন? গরিবের ওপর অত্যাচার করলে আল্লাহ্‌র কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই, শুধু আপনাদেকেই নয়, সমস্ত সরকারি কর্মচারিকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। ’ ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু নানা বক্তৃতায় বারবার সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কথা, মান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার মৌলিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও ক্ষুধাদারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীর এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমি কি চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কি চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন পূরণের পথেই হাঁটছে আজকের আমাদের এই বাংলাদেশ।

সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সোনার বাংলাদেশ গড়ার অভীষ্ট লক্ষ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১এর কালরাতে পাকিস্তানী বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হলে গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরপর প্রহসনের বিচারে পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁকে ফাঁসির দন্ডাদেশ দেয় সামরিক জান্তা সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রবল চাপে এ দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন জাতির পিতা। পূর্ণতা পায় আমাদের বিজয়ের আনন্দ।

স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে দেশ পুনর্গঠনে যখন তিনি গভীরভাবে নিমগ্ন, মোকাবিলা করছেন নানামুখী সংকট ও ষড়যন্ত্র, সে মুহূর্তেই ঘাতকের বুলেটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের আঠারো সদস্য। ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের যেন সুষ্ঠু বিচার না হয় সেজন্য প্রণীত হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক কালো আইন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। এ হত্যাকান্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি গ্লানিমুক্ত হয়। জাতির পিতা আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তিনি অমর, অবিনশ্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে তিনি চিরজাগ্রত। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। তাঁর আদর্শ চিরঅম্লান। তাঁর অর্থনৈতিক ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, দেশের প্রত্যেকটি নাগরিককে প্রকৃত দেশপ্রেমিক, সৎ, নিষ্ঠাবান, সাহসী ও ত্যাগী দেশকর্মী হওয়া উচিত। তাঁর সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোটা জাতিকে উন্নত করতে একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সত্যিকারের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা’, যেমনটি বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে তাঁরই সুযোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পূরো বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময় এবং উন্নয়নের রোল মডেল । বঙ্গবন্ধু কন্যা ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ অর্জন করার জন্য কাজ করছি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুতেই বংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সব কিছুই বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা থেকে উৎসারিত এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে বিনির্মিত। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, রাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

প্রফেসর ড. সেলিনা আখতার : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, রাঙ্গামাটি বিঞ্জান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচেতনায় নজরুল
পরবর্তী নিবন্ধতুলসীধামে ঝুলনযাত্রা উৎসব শুরু