আমি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করি এটা ভেবে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। এই মহান নেতার সান্নিধ্য পাওয়ার দুটো স্মৃতি আমার জীবনের পরম পাওয়া। নিজেকে আরো সৌভাগ্যবান মনে হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৮৪ সালে আমাদের রাউজানের বাড়িতে আগমণ ও রাত্রি যাপন।
আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর,মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে ১৯৪৯ সালে নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তৎকালীন মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা ও মারদাঙ্গা রাজনীতিবিদ ফজলুল কাদের চৌধুরীর দুর্দণ্ড প্রতাপ ও রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে রাউজানে আওয়ামী লীগের বীজ বপন করেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করে সমগ্র পাকিস্তানে বিষ্ময়ের জন্ম দেন। বাবা ছিলেন এম এন এ। ১৯৭১ সালে স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হলে চট্টগ্রামে গঠিত ৫ সদস্যের সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ২য় ফ্রন্ট হিসেবে বিবেচিত চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা,পরবর্তীতে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে ওতোপ্রোত জড়িত ছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভ্থমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের রাউজান থেকে নির্বাচিত প্রথম এম পি, ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলার গভর্নর নিযুক্ত হন।২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করে। বাবার সাথে বঙ্গবন্ধুর ঘণিষ্ঠতার কারণে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল।
১৯৭৪ সালে বাবা তখন গভর্নর। ঐ সময়কার দুটি ঘটনা আমার স্মৃতিপটে আজো ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করে ফেরার সময় রাউজানের এম পি হিসাবে আমার বাবা রাউজান কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। তখন স্কুল ছাত্র–ছাত্রীদের দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফুল দিয়ে বরণের কর্মসূচি রাখেন। সে কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাবা আমাকে রাউজান নিয়ে যান। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে ফুল দিয়ে আমরা বরণ করেছিলাম।
সে সময় একবার বাবার সাথে ঢাকায় গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের হাতের স্পর্শ আজো আমি অনুভব করি। তখন রমজান মাস। ইফতারের সময় হয়ে এলে বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে নিয়ে ইফতার করতে বসেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে ইফতারি করতে গিয়ে খুব অবাক হয়ে গেলাম। আমার ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু দেশের রাজা। গল্পে পড়েছি আর শুনেছি রাজা বাদশাদের খাবারে থাকে শাহী আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ইফতারের মেনুতে তেমন আয়োজন থাকবে বলেই আমার ধারণা ছিল। কিন্তু দেখি তার ইফতারির মেনুতে আছে সাধারণ মানুষের মতোই ছোলা,পেঁয়াজু, মুড়ি। বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম খুব তৃপ্তির সাথে সে সব খাচ্ছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে ইফতার করতে করতে ছোট্ট আমি ভাবছিলাম বঙ্গবন্ধু এতো সাধারণ খাবার খান! আসলে এখানেই বঙ্গবন্ধুর স্বজাত্য প্রেমের পরিচয় ফুটে উঠে। তিনি দেশের সব কিছুকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন বলে বিদেশী, ব্যয়বহুল খাবার তাঁতে তৃপ্তি দিত না। তাঁর স্বভাবের এই তাড়না জাতীয়তাবোধ প্রসুত।
আজ ভাবলে অবাক লাগে ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও বঙ্গবন্ধু সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। সারা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন।ক্ষতায় যাওয়ার পর চাইলে তিনি তার জীবনধারা পাল্টাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি।ক্ষমতার শীর্ষে গিয়েও তিনি সাধারণ মানুষকে ভুলেননি। তাইতো তাঁর জীবন– যাপন, আচরণে কোন পরিবর্তন আসেনি। সাধারণ মানুষের মতোই তিনি জীবন যাপন করতেন।একবার এক বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার বড় গুণ কি? তিনি বলেছিলেন,আমি মানুষকে ভালবাসি।সাংবাদিক এবার বলেন, আপনার বড় দোষ কি? তিনি বলেন, আমি তাদের বেশি ভালবাসি।
দেশের মানুষকে ভালবেসেছিলেন বলে তাদের কল্যাণ চিন্তা তাকে অস্থির করে রেখেছিল। পার্থিব কোন সুখ সুবিধা তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে নি। দেশের মানুষের মুক্তির জন্য তিনি দু’যুগের বেশিকাল তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেছিলেন। এদেশের জনগণের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেওয়ার পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য থেকে তাকে টলানো যায়নি। এই শক্তির মূলে ছিল দেশে ও দেশের মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, রাজনীতি দেশও দশের কল্যাণের জন্য। মানুষকে ভালবাসতে না পারলে তাদের কল্যাণও করা যায় না। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন, আদর্শিক সংগ্রামের জন্য আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আদর্শ কর্মীর প্রয়োজন। অর্থাৎ অসৎচরিত্রের লোকদের দিয়ে সৎ কাজ হয় না। সংকীর্ণ মনোভাব নিয়ে সার্বিক কল্যাণ করা যায় না। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই।ছোট মন নিয়ে বড় কাজ হয় না’।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে হলে নিজেদের সোনার মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার সংকল্প থাকতে হবে। আজ বঙ্গবন্ধু সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে। যদি তাঁর আদর্শকে ধারণ করে দেশ গঠন করা যায়, মানুষের কল্যাণ করা যায় তবেই তার আত্মা তৃপ্তি পাবে। বাঙালি জাতির মুক্তির দূত এই মহান নেতার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক স্লোগান