জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সংস্কৃতি–অন্তপ্রাণ রাজনীতিবিদ। তাঁর নিজস্ব ধারণা ছিল সংস্কৃতি সম্পর্কে। সাহিত্য সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা ছিল। মোটকথা সাহিত্য–সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি যা ধারণা করতেন, তা ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও ব্যক্তি–চেতনায় উজ্জ্বল।
বাংলা সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল তার উদাহরণ দিতে গিয়ে সাংবাদিক–সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী তাঁদের জেলে থাকা সময়ের আলাপচারিতার কথা বলেছিলেন, “বাংলা সংস্কৃতিকে যে তিনি কতটা ভালোবাসতেন সেটা আব্বাসউদ্দিনের সাথে যে কথা তার থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি এটা প্রমাণ করেছেন বাংলা ভাষা ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তিনি জেলখানার মধ্য বসে আলাপ আলোচনা করতেন এ–দেশটাকে আমরা কী করে মুক্ত করবো, কীভাবে পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে ছাড়িয়ে আনবো? এ ব্যাপারে তিনি সবসময় চিন্তা করতেন। তিনি বলতেন খুব হালকা করে। কিন্তু খুব সিরিয়াস কথা আলোচনা করতেন। একটা কথা বলি, জেলখানার মধ্য তিনি বলেছিলেন, তোদের এই পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এটা নিয়ে কী করবি কর! পিআইএ বন্ধ করে দিলে তো তোদের সব শেষ। তার মানে তাঁর এটাই চিন্তা বাংলাদেশ মুক্ত হলে পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কী হবে! আমরা তখন বললাম, বঙ্গোপসাগর দিয়ে যে যুদ্ধজাহাজ আসবে তখন কী করবেন? তখন তিনি খুব হালকাভাবে বলছেন, ‘ভয় করিস না! ওরা সাঁতার জানে না ডুবে মরবে।’ এই যে কথাগুলা তাঁর অজান্তে হোক, কিংবা, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু জহির রায়হানকে একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর ছবি করার কথা বলেছিলেন। ফতেহ লোহানী আলোচনা করেছিলেন তিনি একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর বই করবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটা আর সম্ভব হয়নি। একটা জিনিস মনে রাখা দরকার ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর আর্মানিটোলা ময়দানে বিশাল এক অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেছিলেন। শুনলে অবাক লাগবে আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমান ওইদিন ওই অনুষ্ঠানে একটি ছোট গীতিনাট্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই যে রাজনীতির প্রয়োজনে তাঁরা নন্দনতত্ত্বকে ব্যবহার করেছেন এটাও একটা অসাধারণ ব্যাপার যেটা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। এটা খুব দুঃখের ব্যাপার এই জিনিসটা আমরা হারিয়েছি।”
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভের পরপরই বাংলার কবি সাহিত্যকদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিয়োগ করার জন্য বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তৎকালীন সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিকী পূর্বাণীর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তুলতে সাহিত্যকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছি– শিল্পী, কবি এবং সাহিত্যকদের সৃষ্টিশীল বিকাশের যেকোনো অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে। আজ আমাদের সংস্কৃতির সামনে কোনো চক্রান্ত নেই, শাসন বা নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল নেই। শিল্পী সাহিত্যিকরা আর মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের জন্যে সংস্কৃতি চর্চা করবেন না। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তন সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি কান্না, সুখ দুঃখকে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্যে শিল্পী, সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন আব্বাসউদ্দীনের ভাটিয়ালি গান। তার বর্ণনা পাই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। বঙ্গবন্ধু লিখেন, ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেতো। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলো যেন তাঁর গান শুনছে।’ আব্বাসউদ্দীন নৌকায় ফিরতে ফিরতে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আব্বাসউদ্দীনের কথাগুলো বঙ্গবন্ধু হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, ফলে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে তিনি সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর সংস্কৃতির জগৎ।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী