দেশসহ বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন; দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক ভঙ্গুর এক সামরিক-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাকে মাতৃভাষা মর্যাদাদানের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে এর খন্ডিত কাঠামোর স্বরূপ উম্মোচিত হয়। মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এই সম্পর্কে অনবদ্য ভাষায় বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইন সভার সদস্য কুমিল্লার বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির জোরালো কন্ঠ ধর্মের মোড়কে পাকিস্তান সৃষ্টির অযৌক্তিকতাকেই সুষ্পষ্ট করেছে। পাকিস্তানের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবাদ-আন্দোলন-সংগ্রাম শুধু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে মহিমান্বিত করেনি, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল পটভূমিও রচনা করেছে।
যদিও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সূচনাপাঠ হয়েছিল ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক প্রবর্তিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে। সে সময় রবীঠাকুর রচিত আজকের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ শুধুমাত্র বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অকুন্ঠ সমর্থনকে শাণিত করেনি, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পূণ্য হোক পূণ্য হোক পুণ্য হোক হে ভগবান’ ইত্যাদি রচনা বাঙালি জাতীয়তাবোধের সঞ্চারণকে অভিনব চেতনায় উদ্ভাসিত করেছে। ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য সত্য হচ্ছে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই উজ্জ্বীবিত অপরিসীম আত্মত্যাগের মহিমা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মিছিল-মিটিং, পিকেটিং, বিক্ষোভ ইত্যাদির সমন্বিত প্রয়াস জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে।
ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিসহ ২১ দফা ঘোষিত হয়। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যদের আইন সভা থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার করণীয় সম্পর্কে যুক্তি উত্থাপন করেন। ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। মূলতঃ ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে দাবানল প্রজ্বলিত হয় তারই আলোকে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়।
১৯৫৬ সালের ১৪ জুলাই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রদেশ প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বকে পরিহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগের সভায় প্রস্তাব পেশ করেন। ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হলে চকবাজার এলাকায় পুলিশ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর রাজনীতি নিষিদ্ধ করে সামরিক শাসন জারির পর থেকে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সময় জেলবন্দী জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার লক্ষ্যে বিশিষ্ট ছাত্রনেত্রীবৃন্দের সম্পৃক্ত করে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আবারো ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন সময় কঠিন জেল-জীবন যাপনের পর মুক্ত হয়ে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
বস্তুতপক্ষে প্রস্তাবিত এই ৬ দফাই ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। একই বছর ১লা মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটপরিক্রমায় এক নতুন যাত্রার শুভ সূচনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের জন্য ভয়ংকর বিপদ- আতঙ্কে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৯৬৯ এর ৫ জানুয়ারি গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিকে প্রচণ্ডভাবে বেগবান করে। এই আন্দোলনের ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মামলা প্রত্যাহারসহ শাসকগোষ্ঠী মুক্তিদানে বাধ্য হয়। প্রায় দশ লাখ ছাত্র-জনতার সমাবেশ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিকতায় পরিপূর্ণ দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত বাঙালি জাতিসত্তার মূল্য ও ঐচিত্যবোধসমৃদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। হয়ত অনেকেই জানেন যে, ১৯৭০ সালে বাঙালি ছাত্র আন্দোলনের মুখে ‘পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি’ নামক বইটি স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে প্রত্যাহার করা হয়। প্রসঙ্গত ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘বাংলার মানুষ বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস এবং অতীত জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, আরবি-হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করা হয়েছে, হরফ-সংস্কার, ভাষা-সংস্কার, বানান-সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলন করে তা রুখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বার বার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয় কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে। গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমানি করিয়েছেন। এ অধিকার তাদের কে দিল?’
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার উল্লেখিত উদ্ধৃতি থেকে এ ধারণাটুকু অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, ভাষা আন্দোলন ও বাংলা ভাষাকে মর্যাদাসীন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নিবেদন কতটুকু বিকশিত ও বিস্তারিত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সপ্তাহব্যাপী ভাষা আন্দোলন উদযাপন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন ‘ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল বাংলা একাডেমি। ১৯৫২ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এই ভবনে বসেই ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলির আদেশ দিয়েছিলেন।’ ১০ এপ্রিল ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু দেশের সংবিধানের রূপরেখা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি এবং সঙ্গে সঙ্গে চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আজ আমরা যে সংবিধান দেবো, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তারা দুনিয়ায় সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।’ এ বাস্তব, যৌক্তিক ও সর্বজন-সমর্থিত মৌলিক চার নীতি-আদর্শই মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক দর্শনের দ্যোতক।
প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং ধারাবাহিক পরিক্রমা প্রজন্মের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত করতে হবে। অন্যথায় দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন মাতৃভূমির প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ এবং তার সার্থক ইতিহাস পাঠ ও ধারণে নূন্যতম অবজ্ঞা বা অবহেলা জাতির জন্যে এগিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শন ব্যাহত হবে। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায় ‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শীর, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর’ অনুপম প্রাণশক্তিতে ঋদ্ধ বাঙালি পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও নতুন করে বঞ্চনার বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি গোড়া থেকেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। সকল শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ বাঙালি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রচন্ড প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায়ে মরণপণ ব্রত গ্রহণ করে।
উল্লেখ্য এ প্রেক্ষিতে রক্তক্ষরণ-প্রাণ বিসর্জনের নতুন অধ্যায় রচিত হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। গভীর দুঃখের সাথে স্মরণ করতে হয় শহীদ বরকত-রফিক-জব্বার ও সালামের মতো বিপুল সংখ্যক শহীদানদের জীবন উৎসর্গ। ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপনে একুশের অবিনাশী পটভূমির ভিত্তিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদানের অমর-অক্ষয় ভূমিকা-অবদান অবিস্মরণীয়। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি একদিকে আমাদের জন্য অত্যন্ত শোকাবহ; অন্যদিকে মাথা নত না করে সকল অপশক্তির সংহারে সত্য-ন্যায়ের পতাকা উড্ডীন করার নবতর চেতনার উন্মেষ উৎস। ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করা মানেই দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের শহীদানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে ভাষার মর্যাদা অধিকতর গভীরে প্রোথিত হোক – আজকের দিনে এ প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।