বঙ্গবন্ধু : বিশ্বনেতাদের চোখে অপার বিস্ময়

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু কোনো ব্যক্তির নাম নয়, তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে সুদীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ’। হাজার বছরের পরাধীনতা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে অনন্য বজ্রকণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর প্রশস্ত বুকে ছিলো অসীম সাহস, ছিলো পাহাড়ের মতো দৃঢ় প্রত্যয়। শোষণ-বঞ্চনায় দ্বি-খণ্ডিত মানুষের ব্যথায় তার আহত হৃদয় নৈঃশব্দে কেবলই কেঁদে উঠতো। অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠস্বরও এমন ছিলো যে মৃত্যুভয়ও তাকে কুণ্ঠিত করতে পারেনি। জেল-জুলুম নিপীড়নের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে দমাতে পারেনি। তাই বলা যায় মুজিব মানেই মুক্তি, মুজিব মানেই বাংলাদেশ।

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সকল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সুদৃঢ় নেতৃত্ব গুণের চূড়ান্ত ফসল আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বাংলাদেশ। অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিঙ’ বলে অভিহিত করে। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বের কারণে ব্রিটেনের আরেক শীর্ষ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে বলা হয় ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’। ফিনান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’

বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানি পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’ বিবিসি বলেছিল, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরাও সংকোচবোধ করেছে।’ বিশ্বের বড় বড় নেতা এবং বিশ্ব মিডিয়া বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন করেছেন অসাধারণভাবে। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে অনেক উচ্চ আসনে বসিয়েছেন পরম শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়। বিশ্বনেতাদের চোখে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক বিস্ময়, ঘোর লাগা এক ব্যক্তিত্ব। গত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক নেতার আবির্ভাব হয়েছিলো। সবার থেকে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে স্বীকৃত। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তি ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য।’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ব্যথিত হলেন এভাবে, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’ ১৯৭১ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন উইলি ব্রান্ডিট। ১৯৭৭ সালে পশ্চিম জার্মানিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বাংলাদেশের ভূখণ্ড সম্পর্কে আগে তার ধারণা ছিল না। কিন্তু ডেথ সেলে বন্দি অবস্থায় শেখ মুজিব যে ম্যাজিক পাওয়ার প্রদর্শন করে একটা জাতিকে স্বাধীন করেছেন, সেটা বিশ্বনেতাদের কাছে অলৌকিক ঘটনার মতো ছিল।

বিশ্বনেতারা তাকে এক পলক দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল। এরপর ক্ষোভ প্রকাশ করে উইলি ব্রান্ডিট আরো বলেন, ‘এমন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন বিশ্বনেতাকে তোমরা হত্যা করলে কেন? যাকে ছাড়া বিশ্বনেতারা তোমাদের স্বীকৃতি দিতো না। তার হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববাসী তোমাদের জাতিকে আর বিশ্বাস করে না।’ বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করে ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’
হেনরি কিসিঞ্জারের মূল্যায়নটি অসাধারণ। তিনি বললেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’ ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’ মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বললেন, ‘তোমরা আমার প্রিয়বন্ধু মুজিবকে হত্যা করলে! আমারই দেয়া ট্যাংক ব্যবহার করে! আমি নিজেকেই অভিশাপ দিচ্ছি, কেন আমি তোমাদের ট্যাংক দিয়েছিলাম? মানবতাবাদী মনীষী লড ফেনার ব্রকওয়ে বলেছেন এভাবে, ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরারও চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা। শেখ মুজিবের সাহসিকতা ও ব্যক্তিত্ব কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয় সারাবিশ্বে বিরল।’ বিশ্বজুড়ে নন্দিত ফ্রান্সের নেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তাকে নেপোলিয়ন দ্য গ্রেট বলা হয়। সেই নেপোলিয়নের চাইতেও বঙ্গবন্ধুকে সফল বলে মন্তব্য করেছেন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রানচিস মিতেরা। ইংলিশ এমপি জেমসলামন্ড তার মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’

আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক ও মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী নেতা মাহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলও বাংলাদেশকে চিনতো বঙ্গবন্ধুর নামে। বাঙালির জাতির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধুকে খুনের ঘটনায় বিশ্ববাসী এই জাতি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে।

জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান অথবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর দেখার পর তাঁরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নিজের হাতে মন্তব্য লিখেছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধুকে বড় মাপের নেতা আখ্যা দেন। তিনি বলেন, একজন বড় মানবতাবাদী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সব মানুষের সমতা ও সুযোগের পক্ষে ছিলেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বঙ্গবন্ধুকে সাহসী নেতা আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘আই স্যালুট দ্য ব্রেভ লিডার অব অল টাইমস।’

মন্তব্য বইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে চিঠি লিখেছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। তিনি লিখেন, ‘প্রিয় শেখ মুজিব, মানুষ বলে তুমি মৃত। কিন্তু আমি অনুভব করি তুমি আজও আমাদের চারপাশে। আমি খুশির সঙ্গে জানাতে চাই যে তোমার স্বপ্ন আজ তোমার মেয়ে শেখ হাসিনার দ্বারা পূরণ হয়েছে। তুমি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছ। তুমি কেবল বঙ্গবন্ধু নও, ভুটানেরও বন্ধু।’ এভাবেই বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুকে মানবতা ও মুক্তির দূত হিসেবে গণ্য করতেন।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধসারের দাম কেজিতে বেড়েছে ছয় টাকা
পরবর্তী নিবন্ধঅবরোধে অচল চবি