বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির চিরন্তন প্রেরণার উৎস

ছন্দা চক্রবর্তী | মঙ্গলবার , ৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

এক একজন মানুষের এক এক রকম বিশেষ গুণ থাকে। কিছু কিছু গুণ বা ক্ষমতা এক একটি মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে তোলে। আবার একটি মানুষের মধ্যে যখন অনেক গুণাবলী বা ক্ষমতার সমাহার দেখা যায় তখন তাঁকে আমরা অনন্য বলি। শুধু যে গুণাবলি আছে তা নয়, এই গুণাবলির প্রায়োগিক ব্যবহার সাধারণ মানুষকে চমৎকৃত করে তোলে। মানুষ তাঁকে ভরসা করে, বিশ্বাস করতে শেখে, তাঁর উপর আস্থা রাখে, ফলে মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা, আকৃষ্ট করা, বুঝতে এবং বুঝাতে পারা এ সমস্ত গুণাবলির যখন সমাবেশ ঘটে, তখন জনগণ তাঁকে নেতা বলে ভাবতে শেখেন। নেতা তাকেই বলা হয়, যিনি নিজের কথা না ভেবে, অন্যের সমস্যা নিয়ে ভাবেন, সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন, সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ এর কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তখন জনগণ নেতাকে বিশ্বাস করে, সুখ দু:খের সঙ্গী মনে করে, নিজেদের পথপ্রদর্শক ভাবেন। ঠিক তেমনি একজন নেতা যাঁর ছাপ্পান্ন বছর জীবন এর ১৪ বছর এই বাংলার মানুষের অধিকার আদায় এর জন্য কারাভোগ করেছেন। এমন একজন ত্যাগী নেতা, সূর্যসম প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন গোপালগঞ্জ এর টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা বেগম এর কোলে। সময়টা ছিল ১৯২০ সালের ১৭মার্চ। পারিবারিক আদুরে নাম ছিল খোকা, আসল নাম শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ায় এখনো বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী যারা বেঁচে আছেন তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন মজিবর। গত ১৭ মার্চ ২০২৩ ছিল তাঁর ১০৩ তম জন্মবার্ষিকী, ১০৪তম জন্মদিন, যে দিনটি এখন শিশুদিবস হিসেবে সরকারিভাবে পালিত হয়। শিশুদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ১৯৯৬ সাল থেকে পালিত হওয়া শিশুদিবস এই বছর ২৮তম শিশুদিবস হিসেবে পালিত হলো। আমি মনে করি বাংলার কোলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ শিশুটি এই দিনে জন্ম নিয়ে ছিল বলে এদিন শিশুদিবস পালন একদম যুক্তি যুক্ত।

বঙ্গবন্ধু তার জন্মদিন পালনে তেমন আগ্রহী কখনোই ছিলেন না। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ৫২তম জন্মদিনে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই দু:খিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কী আর মৃত্যুদিনই বা কী! আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা জানেন, এদেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই কোনো মহিমা, যখনি কারো ইচ্ছা হলো তখনিই আমাদের প্রাণ দিতে হয়। বাংলাদেশের জনগণের কোনো নিরাপত্তাই তারা রাখেনি, জনগণ আজ মৃতপ্রায়। আমার আবার জন্মদিন কি? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্য। আমি যে তাদেরই লোক’। ঠিক তাঁর ৫২ বছর পর এই ২০২৩ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলাদেশের জনগণ পালন করলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন বা জাতীয় শিশু দিবস ২০২৩, যার প্রতিপাদ্য ছিল-‘স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন /শিশুদের চোখ সমৃদ্ধির স্বপ্নে রঙিন’।

বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ভাবনা ছিল অসামপ্রদায়িক ও পরোপকারী। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান, মানব দরদী, কিন্তু অধিকার আদায়ে আপোষহীন। কিশোরবেলা থেকেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা খোকাকে অন্যদের থেকে পার্থক্য করা যেত। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর মধ্যে এই ক্ষমতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলি পরিলক্ষিত হয়। চল্লিশের দশকে এই তরুণ ছাত্রনেতা ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’ ও ‘শেরে বাংলা এ,কে,ফজলুল হক’ এর সংস্পর্শে এসে সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবদুল মান্নান এর লেখায় আছে, ‘বঙ্গবন্ধুর মতো পড়ুয়া রাজনীতিবিদ তখনও তেমন একটা ছিল না, আর এখন তো একেবারেই নেই। তিনি সময় পেলেই উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রতিবাদী মানুষের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতেন’। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারে রোজনামচা’য় ও তাঁর পড়ুয়া স্বভাবের কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ মহান নেতার চিন্তা চেতনায় সবসময় ছিল বাংলা, বাঙ্গালী ও বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চর্চার লক্ষ্য ছিল অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণ, সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নে বিশ্বাসী, শোষকের আধিপত্যে বিদ্রোহী মনোভাবসম্পন্ন ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কিন্তু ধর্মহীন নয়, ধর্মকে তিনি ব্যাক্তিজীবনে রাখাতে বিশ্বাসী, সবধর্মের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন এবং রাষ্ট্রকে তিনি ধর্ম থেকে আলাদা রাখায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই সমস্ত দর্শন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিরকালীন স্বপ্ন ছিল বাংলার জনগণের মুক্তি, বাংলার স্বাধীনতা।

১৯৪৮ সালের ১১মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতির দাবীতে সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে তিনি গ্রেফতার হন। এরপর থেকেই ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে যথাক্রমে ৫৪এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮এর আয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬২এর শিক্ষাকমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬এর ছয়দফা, ৬৮এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০এর নির্বাচন, এবং৭১এর ৭মার্চ এর মুক্তি যুদ্ধের দিকনির্দেশনামূলক ১৮ মিনিটের বজ্রকণ্ঠের ভাষণ এবং পরিশেষে ২৫ মার্চের কালরাত্রির সময়ে পাকিস্তানের হাতে গ্রেফতার, ও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে দেওয়া স্বাক্ষর, এতসব কিছুর নিউক্লিয়াস ছিলেন তিনি, যিনি এরই মধ্যে ৬৯ এ জনগণ কর্তৃক উপাধি প্রাপ্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসাবে পরিচিত। তাঁর সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, ও নেতৃত্ব, বক্তব্য উপস্থাপন এর আন্তরিকতা, সমগ্র জাতিকে এক সূত্রে গ্রোথিত করেছিল। যার ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই তো ৭১এর অগ্নিঝরা মার্চের ২৬ তারিখে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত দিনটি বাঙালির কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অমোঘ বাণী ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে’। এই মূলমন্ত্র নিয়ে আপামর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘নয়’ মাস যুদ্ধ করে এই বাংলাকে পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতা থেকে মুক্ত করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। এই দু:সাহসিক যুদ্ধের সর্বাত্মক সাথী হিসেবে ছিলেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সরকার, ভারতের সেনাবাহিনী তথা মিত্রবাহিনী, ভারতের সাধারণ জনগণ যারা বাংলাদেশের আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন, বিশেষ করে ভারতের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলো। পাকিস্তানি সৈন্যরা পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করলো। কিন্তু এদেশের শোকার্ত মানুষের মনে শান্তি, স্বস্তি কিছুই ছিল না, কারণ বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানের কারাগারে, দেশি বিদেশি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক তৎপরতায় অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। এসেই তিনি বললেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে’।

দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু ঈর্ষাপরায়ণ নির্বোধ কিছু ষড়যন্ত্রকারীর ষড়যন্ত্র থেমে থাকল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাঙালির ললাটে পিতৃহন্তার তিলক সেঁটে দিল। ভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকায় বেঁচে গেলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েশেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা।

৭৫ এর পর নানা ঘাত প্রতিঘাত, চড়াইউতরাই পার হয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার হাতে এখন আজকের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়। অচিরেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা তথা উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে।

একটাই আশার কথা এই যে, জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব এখন অনেক বেশি জীবন্ত। যত দিন পার হচ্ছে তত মুজিব জনগণের হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধায় প্রোথিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির চিরন্তন প্রেরণার উৎস। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নীতি ও আদর্শের প্রতীক। নতুন প্রজন্মের প্রতি আহবান থাকবে বাংলাদেশকে জানতে হলে, বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তি সংগ্রামের নেতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজনমানুষের আস্থা নিয়ে গড়ে উঠুক আধুনিক ব্যাংকিং সংস্কৃতি
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ১১.৮৪ কোটি টাকা