হরতালের মাঝেও বঙ্গবন্ধু টানেলে গতকাল প্রথম দিনে চলেছে কয়েক হাজার গাড়ি। স্বপ্নের টানেল পার হওয়ার জন্য দলে দলে ছুটেছে মানুষ। মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন মিনিটে পার হতে পেরে উচ্ছ্বসিত তারা। রাত তিনটা থেকে লাইন ধরে অপেক্ষায় ছিলেন অনেকে। সকাল ৬টায় টানেল খুলে দেওয়ার সাথে সাথে কার আগে কে যাবেন শুরু হয় প্রতিযোগিতা। টানেলের প্রথম যাত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা জুয়েল রানার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ২শ টাকা টোল দিয়ে প্রথম যাত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন তিনি। গত রাত ১২টা পর্যন্ত ১৮ ঘণ্টায় মোট ৫ হাজার ৮৩টি গাড়ি টানেল দিয়ে চলাচল করেছে। এতে ১০ লাখ ৮২ হাজার ৭০০ টাকা টোল আদায় করা হয়েছে। টানেলের ভিতর দিয়ে দৈনিক প্রায় ২০ হাজার গাড়ি পারাপারের অবকাঠামোগত সক্ষমতা রয়েছে।
পতেঙ্গা ও আনোয়ারা অঞ্চলের মানুষ স্বপ্নেও ভাবেনি এমন সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে এলাকায়। পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারায় যেতে ১৫ নম্বর ঘাট দিয়ে জীবন হাতে নিয়ে সাম্পানে পারাপার করত মানুষ। আবার কর্ণফুলী ব্রিজ হয়ে শহর থেকে আনোয়ারার কাফকো, সিইউএফএল কিংবা পারকি পর্যন্ত যেতে দেড় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যেত। কখনো আরো বেশি। কিন্তু টানেল চালু হওয়ায় মাত্র কয়েক মিনিটে মানুষ পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারায় পৌঁছে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার জাদুকরি এই পরিবর্তনে মানুষ উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত। দেশের প্রথম টানেল হিসেবে শুধু চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের মানুষই উচ্ছ্বসিত।
এই উচ্ছ্বাসের মধ্যে টানেল পারাপার হতে শনিবার রাত থেকে আনোয়ারা ও পতেঙ্গায় অবস্থান নেয় অসংখ্য মানুষ। টানেলের প্রথম যাত্রী হওয়ার জন্যও অপেক্ষা করে অনেকে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে টানেল খোলার পর অপেক্ষমাণ গাড়িগুলো টানেলে প্রবেশ করতে থাকে। রাত তিনটা থেকে অপেক্ষা করতে থাকা অনেকেই প্রথম যাত্রী হওয়ার চেষ্টা করেন। এরা টানেলে প্রবেশের সময় গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়ে উচ্ছ্বাস করতে দেখা গেছে। সকলে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলেন। উচ্ছ্বসিত একদল মানুষের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস সকালের আলোয় মোহনীয় হয়ে ওঠে।
টানেলে প্রথম যাত্রী হিসেবে টোল পরিশোধ করেন মুন্সিগঞ্জের জুয়েল রানা। তিনি বলেন, রাত থাকতেই টানেল এলাকায় এসে অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু এ সময় আরো অনেকগুলো গাড়ি এসে অপেক্ষা করতে থাকে। তখন মনে হয়েছিল, প্রথমে টোল দিয়ে প্রথম যাত্রী হওয়ার যে আগ্রহ নিয়ে সারা রাত নির্ঘুম থেকে এখানে এলাম সেটি পূরণ হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত আমার আশা পূরণ হওয়ায় বেশ ভালো লাগছে। আমিই প্রথম টোল পরিশোধ করেছি।
মোহাম্মদ শাহেদ কঙবাজার থেকে এসে রাত ৩টা থেকে টানেলে প্রবেশের জন্য আনোয়ারা প্রান্তে অবস্থান করছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সারা জীবন গাড়ি চালালাম সেতু আর ফেরি পার হয়ে। এবার নদীর নিচ দিয়ে যাব, খুব উত্তেজনা কাজ করছে।
শুধু জুয়েল রানা ও শাহেদ নন, টানেলে প্রবেশ করে সকলেই আনন্দিত। সাতকানিয়ার গাড়ি চালক মোহাম্মদ শফিক আলম। তিনি আনোয়ারা প্রান্তে টোল পরিশোধ করে মোহাম্মদ জাকারিয়া নামের এক যাত্রীকে নিয়ে বিমানবন্দরে আসেন। শফিক বলেন, এত তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাচ্ছি, আশ্চর্যের বিষয়!
এদিকে পতেঙ্গা প্রান্তে রাত থেকে ছিল অপেক্ষমাণ মানুষ। অনেকে পতেঙ্গা সৈকতে অবস্থান করছিলেন গভীর রাত থেকে। সকাল ৬টায় যান চলাচল শুরু হওয়ার সাথে সাথে টানেলে প্রবেশ করেন দুলাল সিকদার, তার স্ত্রী সালমা আক্তার ও সন্তানেরা। সালমা বলেন, আগে টোল দিতে পারলাম না এটা ঠিক। তবে আগে টানেলে প্রবেশ করেছি। টোল প্লাজা আনোয়ারায় হওয়ায় টানেল পার হয়েই আমাদেরকে টোল পরিশোধ করতে হবে। তবে সবার আগে টানেলে ঢুকতে পেরে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।
প্রথম যাত্রীবাহী বাস হিসেবে টোল দেয় বিডি বাস লাভার গ্রুপের মারসা কোম্পানির একটি বাস। বাসটি ফুল ও কাপড় দিয়ে সাজিয়ে উৎসবের আমেজ নিয়ে তারা টানেলে প্রবেশ করেন। গ্রুপের সদস্য জুনায়েদুল হক বলেন, আমরা রাত ১২টা থেকে পতেঙ্গা প্রান্তে অবস্থান নিই। টানেল খোলার অপেক্ষা করি। সকাল ৬টার সময় টানেল খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকি।
ফরিদুল আলম ও ওমর ফারুক নামে দুজন বলেন, বিদেশে দেখেছিলাম টানেল। এখন আমরা আমাদের দেশে দেখলাম। শহর থেকে আনোয়ারা আসতে আগে দুই–তিন ঘণ্টা লেগে যেত। এখন তিন–চার মিনিটে পৌঁছলাম। ভালো লাগছে। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
টানেলের টোল আদায়কারী (কালেক্টর) জুবায়েরুল ইসলাম তুরাব বলেন, রাত থেকে চালক–যাত্রীরা যান নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর টানেলে প্রবেশের সময় সবার চোখে–মুখে ছিল উচ্ছ্বাস। সেই সঙ্গে আমাদেরও। যা ছিল স্বপ্নের মতো, এখন তা বাস্তব। এই অনুভূতি আসলে অন্যরকম।
নিজে গাড়ি চালিয়ে নগরী থেকে আনোয়ারায় যাচ্ছিলেন আনিতা মুবাশ্বিরা। আনোয়ারা প্রান্তে টোল পরিশোধ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, টানেলের ভিতর দিয়ে এসেছি। এই অনুভূতি অন্যরকম। এটা বলে বোঝাতে পারব না। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম টানেল আমাদেরই। এটি বড় ব্যাপার, অনেক গর্বের ব্যাপার।
নোয়াখালীর বসুরহাট থেকে সুমাইয়া জান্নাত কোম্পানির বাস ভাড়া করে ৬/৭ জনের একদল যুবক টানেল দেখতে আসেন। গতকাল তারা পতেঙ্গা প্রান্ত দিয়ে টানেল পার হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে টোল পরিশোধ করেন। এরপর বাস থেকে নেমে সেখানেই নেচে–গেয়ে উচ্ছ্বাস করতে থাকেন। তাদের উচ্ছ্বাস আশেপাশে অপেক্ষমাণ যাত্রী এবং টোল প্লাজার কর্মীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টোল প্লাজার একজন কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, আমরা সকাল ৬টার সময় যান চলাচলের জন্য টানেল খুলে দিয়েছি। গত রাত ১২টা পর্যন্ত ১৮ ঘণ্টায় মোট ৫ হাজার ৮৩টি গাড়ি টানেল দিয়ে চলাচল করেছে। এতে ১০ লাখ ৮২ হাজার ৭০০ টাকা টোল আদায় করা হযেছে। হরতালের কারণে দিনের বেলা গাড়ি কম চললেও বিকাল থেকে গাড়ির ঢল নামে। সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত টানেল দেখতে উৎসাহী প্রচুর মানুষ পতেঙ্গা এবং আনোয়ারা প্রান্তে ভিড় করেন। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়ানোর জন্য টানেল পার হয়েছেন। পতেঙ্গা ও আনোয়ারা অংশে টানেল নিয়ে উৎসবের আবহ বিরাজ করছে বলে জানান তিনি। এদিকে টানেলের ভিতরে গতিবেগ ৬০ কিলোমিটার রাখার নির্দেশনা রয়েছে। ভিতরে কোনো যানবাহন দাঁড়াতেও পারবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশীদ বলেন, সকাল ৬টায় যান চলাচলের জন্য টানেল খুলে দিয়েছি। তখন থেকে টানেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন পারাপার হয়েছে। গতকালের হিসাবকে উদাহরণ হিসেবে আনার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, হরতালের কারণে প্রথম দিনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ধরা যাবে না। সন্ধ্যার পর থেকে গাড়ি চলাচল বেড়েছে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর বহরে ২১টি গাড়ি টানেল পার হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজের গাড়ির জন্য ২০০ টাকা এবং বহরের ২০টি গাড়ির জন্য ৪ হাজার টাকা টোল পরিশোধ করেছিলেন।