সিআরবি সাত রাস্তার মোড় থেকে বইমেলা প্রাঙ্গণ। দূরত্ব আনুমানিক একশ গজ। এক মিনিটেরও কম সময়ের হাঁটাপথ। স্বল্প দূরত্বের এ পথ পার হতে কয়েক মিনিট লেগেছে গতকাল সন্ধ্যায়। কারণ পুরো পথ লোকে লোকারণ্য। কেউ বইমেলায় প্রবেশ করছেন, কেউ বা বের হচ্ছেন এ পথ দিয়ে। এ যেন ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ অবস্থা।
কয়েক মিনিটের চেষ্টায় ভিড় এড়িয়ে শিরীষতলা অর্থাৎ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেও ‘চোখ ছানাবড়া’ দশা। কারণ এ বছর মেলা শুরুর পর থেকে এ প্রথম একসঙ্গে এত লোকের উপস্থিতি। স্টলে স্টলে উপচে পড়া ভিড়। স্টলের দুই সারির মাঝের যে পথ সেখানেও হাঁটা দায়। অবশ্য প্রবেশপথের ভিড় দেখে মেলার ‘জনস্রোত’ আন্দাজ করা গেছে আগেই। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এমন লোকসমাগমকে প্রত্যাশিত বলেছেন প্রকাশকরা। কয়েকজন প্রকাশক বলেন, বেচাকেনাও ভালো হয়েছে। তাই সন্তুষ্ট তারা। তবে কিছু কিছু প্রকাশক বরাবরের মত জানালেন, লোক বাড়লেও পাঠক কম। ‘কালধারা প্রকাশনী’র স্টলে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, নানা বয়সী মানুষ সাজিয়ে রাখা বই দেখছেন। পছন্দ হলে কিনছেন কেউ কেউ। প্রকাশনা সংস্থাটির স্বত্বাধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু আজাদীকে বলেন, বেচাকেনা সন্তোষজনক। কালধারা প্রকাশনী থেকে এবার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছয়টি মুক্তিযুদ্ধের ওপর।
খড়িমাটি প্রকাশন এর স্বত্ত্বাধিকারী মনিরুল মনির আজাদীকে বলেন, বেচাকেনা তেমন ভালো না। এখানে বেশিরভাগ ঘুরতে আসেন। যাতায়াত ব্যবস্থার সমস্যার কারণে প্রকৃত পাঠক কম আসছেন।
আবির প্রকাশন এর স্বত্বাধিকারী মুহম্মদ নুরুল আবসার আজাদীকে বলেন, আজ (গতকাল) প্রচুর মানুষ। বিক্রিও টুকটাক হচ্ছে, খারাপ না। ভালো বইয়ের পাঠক আছে। বিষয়বস্তু ভাল হলে লেখক কে সেটাও দেখেন না পাঠক, কিনে পেলেন। তিনি জানান, আবির প্রকাশন থেকে এবার প্রকাশিত ২৫টি নতুন বই এসেছে মেলায়। বেশিরভাগ প্রবন্ধের।
আপন আলো প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী শামসুদ্দিনশিশির বলেন, প্রচুর মানুষ আছে ঠিকই। তবে একটি অংশ বই নিয়ে কেবল ছবি তুলেন। আপন আলো প্রকাশিত ১৫টি বই এসেছে। বেশিরভাগ গবেষণাধর্মী। গবেষণার বইয়ের পাঠক কম, তাই আমাদের বিক্রিও কম।
মেলায় মেয়েকে নিয়ে এসেছেন শিক্ষক মনজুর। তিনি বলেন, বিক্রি কেমন হচ্ছে জানি না। তবে আজকের (গতকাল) জনস্রোত দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। ঘুরতে আসুক, কিন্তু তারা তো বইয়ের মেলায় এসেছেন। ভালো জায়গায় এসেছেন।
এক হাতে বইয়ের ব্যাগ। অন্য হাতে ‘বাতিঘর’ এ সাজিয়ে রাখা বইয়ের মলাট উল্টাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফৌজিয়া। তিনি জানান, উপন্যাস এবং অনুবাদের তিনটি বই কিনেছেন।
প্রসঙ্গত, গতকাল ছিল মেলার ৭ম দিন। মেলা চলবে আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত। মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
নতুন বইয়ে খবর : মেলায় আসা নতুন বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আজাদ বুলবুল এর ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতির প্রামাণ্য পরিচয়’, মোস্তাক আহমদ এর ‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী’, আইউব সৈয়দ এর কাব্যগ্রন্থ ‘কখনো ছন্দ কখনো দ্বন্দ্ব’, রূপক বরন বড়ুয়া’র কাব্যগ্রন্থ ‘পরান কাঁদের’, আহমেদ ইফতেখার রবি’র উপন্যাস ‘সংশপ্তকের আলোকযাত্রা’, সুহান রিজওয়ানের ‘মুখোশের দিন বৃষ্টির রাত’ ও ওয়াহিদ সুজনের ‘অসুখের দিন’।
ফ্ল্যাপের তথ্য অনুযায়ী আজাদ বুলবুল এর ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতির প্রামাণ্য পরিচয় নিছক একাডেমিক তত্ত্বের সন্দর্ভ নয়, বরং ত্রিপুরা জাতির বর্ণিল সংস্কৃতির অনালোচিত অধ্যায়। আজাদ বুলবুল দীর্ঘদিন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে থেকেছেন। তাদের জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। যোগ দিয়েছেন তাদের উৎসব অনুষ্ঠানে। ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতির প্রামাণ্য পরিচয়’ আবিষ্কার করতে গিয়ে অংশগ্রহণমূলক গবেষণা পদ্ধতিতে তিনি তুলে এনেছেন এই জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, উৎপাদন, বিনোদন থেকে যাপিত জীবনের সকল বিষয় আশয়।’
সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী এবং চলমান ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে যা দেখে চোখ বন্ধ করে রাখা যেতো না তার কিছু অবতারণার চেষ্টা করেছেন মোস্তাক আহমদ, তার ‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী’ গ্রন্থে। তিনি বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছি। চর্তুদিকে বিষাক্ত সাপ ফনা তুলে আছে। তারপর ও লক্ষ স্থির করে উল্কার মতো ছুটে চলেছি। সে চলার পথের কিছু বাস্তব কাহিনী নিয়ে সাজানো এ বইয়ের কথামালা। তখনকার যে প্রেক্ষাপট এখন থেকে অনেক ভিন্ন ছিল।
আইউব সৈয়দ এর ‘কখনো ছন্দ কখনো দ্বন্দ্ব’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কবি ফাউজুল কবিরের মূল্যায়ন হচ্ছে– ‘বাংলা কবিতার সবক’টি ছন্দকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নির্মাণ করেছেন এই গ্রন্থটি। কখনো ছন্দ কখনো দ্বন্দ্ব পাঠককে টানবেই। কারণ এখানে জীবনের সহজ চর্যা পাঠ আছে। জগৎ সংসারের প্রাত্যহিকের অনন্য রূপ–ধ্বনির মহিমা আছে নির্মাণে। আছে টুকরো টুকরো অনেক কথা। এ কাব্যে ‘অরূপে জেগেছে ছন্দ। কোথাও জেগেছে দ্বন্দ্ব’ এ কথাই শিল্পের মূলকথা–মর্মবাণী। সহজের কথামালা, জীবনের আরতি–বাক্যাবলি শব্দাবলি যখন অরূপের রূপ ধরে–তখনই গড়ে ওঠে, নির্মিত হয় কখনো ছন্দ কখনো দ্বন্দ্ব।’
রূপক বরন বড়ুয়া’র কাব্যগ্রন্থ ‘পরান কাঁদের’ আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। কাব্যগুলো চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানকে কেন্দ্র করে রচিত। শিরোনামও তাই। যেমন– ‘শিরিষতলা, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, রাউজান, লালখানবাজার এবং মেথরপট্টি। ফ্ল্যাপে লেখা আছে– ‘পরান কাঁদের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সনেটকাব্য গ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাসের কিছু প্রাচীন ইতিহাস তুলে আনতে গিয়ে সনেটের কাঠামো ও আঙ্গিক ঠিক রাখতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাব্যবিন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার স্বরে পরিবর্তন এসেছে। এরপরও এই গ্রন্থ ইতিহাস আশ্রয়ী প্রথম আঞ্চলিক ভাষায় সনেট কাব্যগ্রন্থ। এখানেই পাওয়া যাবে চট্টগ্রামের কিছু স্থানের আদি ঠিকানা, স্বরূপ ও প্রাচীন ইতিহাস।’
মেলা মঞ্চে শিশু উৎসব : গতকাল বইমেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘শিশু উৎসব’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিশুরাই জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। একটি জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির বীজ সুপ্ত অবস্থায় লুকায়িত থাকে শিশুর মধ্যেই। শিশু জন্ম নেওয়া মানে যে শুধু সেই শিশুটার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে এমনটা কিন্তু নয়, বরং একটি জাতির উন্নতির সঞ্চার হয় সুষ্ঠু পরিবেশে বিকশিত হওয়া সেই শিশুর মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বক্ষেত্রে সকল শিশুকে পূর্ণ মর্যাদাবান মানুষরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
শিশু সাহিত্যিক ও নাট্যজন অধ্যাপক সনজীব বড়ুয়ার সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বই মেলা’র আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দীন আহমেদ মঞ্জু। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি নাজিম উদ্দীন শ্যামল ও কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল।