আমরা যারা বাংলা আধুনিক গান ও ব্যান্ডের গান পছন্দ করি, জনপ্রিয় গান গুলো গাইতে ও শুনতে আগ্রহ বোধ করি; কিন্তু বেসুরোভাবে গান গাইলে তা কখনোই শ্রুতিমধুর যেমন হয় না, তেমন আবার গানের বিকৃতিও ঘটে। সঠিক সুরে ও উচ্চারণে গাইতে পারাও বড় কৃতিত্বের ও সাধনার বিষয়।
আশির দশক থেকে গান লিখছেন গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। দেশের বিভিন্ন ব্যান্ড ও আধুনিক গানের কণ্ঠশিল্পীদের কাছে তিনি বরাবরই পছন্দের নাম। তাঁর লেখা গান মাতিয়েছে সকল বয়সী শ্রোতাদের। তরুণ প্রজন্ম গায় তাঁর লেখা গান। আর গানগুলো গেয়েছেন দেশের বরেণ্য শিল্পীবৃন্দ। সুরও করেছেন দেশ বরেণ্য সুরকার। সবচেয়ে মজার বিষয়, নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও জঙ্গী ভাইয়ের গান গাইছেন।
গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী এবার তিনি তাঁর লেখা জনপ্রিয় পঞ্চাশ গান মলাটবন্দী করে শ্রোতা, পাঠক এবং কণ্ঠশিল্পীদের জন্য নতুনতর আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। কেমন এই বইটি? বা কোথায় এর নতুনত্ব? এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘করোনাকাল চলছে। ভাবনাটা এলো ঐ সময়ে। এদিকে বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর। সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হবে। এমন সুবর্ণ সময়কালে নিজের লেখা পঞ্চাশটি গান নিয়ে একটি বই বের করলে কেমন হয়, সেই সাথে যদি থাকে গানের কর্ড এবং কিছুটা অলংকরণ? প্রকাশক ছাড়াও কাছের কিছু মানুষের সাথে আলাপ করলাম। সবাই উৎসাহের সাথে এই ভাবনার প্রশংসা করলো।’ আসলে বাংলাদেশের আধুনিক গানের ইতিহাসে কর্ড সম্বলিত গানের বই নাই। রবীন্দ্র–নজরুলের বিষয়টি আলাদা।
যা হোক, বিষয়টিতে নতুনত্ব যেমন আছে, তেমন আবার সকলের জন্য শুদ্ধভাবে গান করতে উদ্বুদ্ধকরণের বিষয়টি জড়িত। শ্রদ্ধেয় শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের সাথে আলাপচারিতায় এই বই প্রকাশনার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে। এক রাতে জঙ্গী ভাই বইটির প্রচ্ছদ পাঠালেন ম্যাসেঞ্জারে। চমকে যাই। কারণ, নতুনত্ব ও অভিনবত্ব আছে। যাক, ২০২২ সালের বইমেলার আগেই ‘আজব প্রকাশ’ বইটি প্রকাশ করলো।
গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের লেখা গান সকল বয়সীদের অন্তর ছুঁয়ে যায়। যার কারণে, তাঁর লেখা গানের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। সমাজচিত্র যেমন আছে, তেমনি প্রেমিক মনের নানান বর্ণিল রূপ দেখা মেলে। আবার আমাদের বিভিন্ন সময়কালের কথাও সুন্দর গীতিময় হয়ে উঠেছে। এজন্যই তাঁর লেখা গান মাতিয়েছে সকলকে। যেমন– ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ গানটির কথা বলি।
‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে
মায়াবী সন্ধ্যায়
চাঁদ জাগা এক রাতে
একটি কিশোর ছেলে
একাকী স্বপ্ন দেখে
হাসি আর গানে
সুখের ছবি আঁকে
আহা কী যে সুখ’
১৯৯০ সালে লেখা গানটি বাংলাদেশের প্রথম রক ধাঁচের গান, যা সুরারোপ করেছেন ও গেয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু (এলআরবি ব্যান্ড)। এই গানটি এক কিশোর ছেলেকে নিয়ে লেখা, যার স্বপ্ন বা ভাবনায় এক রঙিন ভুবন। কিন্তু সেই রঙিন ভুবনটা হারিয়ে যায়। এই গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অসাধারণ সুর ও কণ্ঠ গানটিকে দারুণ এক মাত্রায় নিয়ে গেছে।
জঙ্গী ভাই লিখেছেন জীবনমুখী গান। তার একটি হলো–
‘হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়
আঘাত দিলে ভেঙে যাবে
মন উড়ন্ত কোনো বেলুন নয়
হুল ফুটালে চুপসে যাবে’
গানটি সুর করেছেন নকীব খান ভাই। গেয়েছেন রেনেসাঁ ব্যান্ড এবং নীলুফার ইয়াসমিন। গানটির কথাগুলো ভাবুন তো– আমাদের হৃদয় কী এতটাই ঠুনকো, কারও কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলেই জীবন নিঃশেষ করে দেওয়ার কোন মানে নেই। সুন্দর এক জীবন চেয়ে আছে আমার দিকে। তাকে পরিপূর্ণ করে সাজাই আবার। এমন আহ্বান একমাত্র গানেই সম্ভব। অসাধারণ সুরে ও গায়কীতে তুমুল আলোড়িত করেছে সকল বয়সী শ্রোতাদের।
ঐ সময়ের আরেকটি গান–
‘আজ যে শিশু
পৃথিবীর আলোয় এসেছে
আমরা তার তরে
একটি সাজানো বাগান চাই’
সুর করেছেন পিলু খান। ব্যান্ড রেনেসাঁ। এই গানটিতে উঠে এসেছে সমাজচিত্র। পথের পাশে অবহেলিত শিশুদের নিয়ে সকলের কাছে কবির তাঁর ভাবনা বা ইচ্ছেকে ব্যক্ত করেছেন। এই গানটি ইউনিসেফ স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই এই গানটি বিশেষ গুরুত্ব রাখে। অনেক বছর আগে বিটিভিতে প্রচারিত প্রয়াত আনিসুল হকের উপস্থাপনায় ঈদ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংগীতানুষ্ঠানে বরেণ্য সংগীত শিল্পী কলিম শরাফী এই গানটি গেয়েছিলেন।
আরেকটি ভালো লাগার গান–
‘হারানো দিনকে যদি ফিরে আমি পাই
তোমাকে আর ফেরাবো না
দুঃখ স্মৃতি যদি সুখ স্মৃতি হয়
তোমাকে আর ফেরাবো না।’
আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের সুরে গানটি গেয়েছেন তপন চৌধুরী। এটিও জনপ্রিয় হয়েছে।
এবার উল্লেখ করি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান প্রসঙ্গে। এক সময়ে শেফালী ঘোষ এবং শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের আঞ্চলিক জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলো। তাঁদের পর আর তেমন একটা চর্চা হয়নি। মাটির টানে আকৃষ্ট হয়েছেন গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। লিখেছেন গান–
‘আঁরো দেশত যাইয়ু তুঁই
আঁরো বাড়িত যাইয়ু
বন্ধুরে একবার বেড়াই
আইয়ু… ’
১৯৭৮ সালে তিনি এই গানটি লিখেছেন। সুর করেছেন নকীব খান ভাই। ব্যান্ড রেনেসাঁ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে যুক্ত করার এই উদ্যোগের জন্য শ্রদ্ধা জানাই। তিনি এক অসাধারণ কাজ করেছেন। পরে ব্যান্ড সংগীতে আঞ্চলিক গানের চর্চা হয়েছে। তবে উদ্যোগটা ছিল জঙ্গী ভাইয়ের।
আরেকটি জনপ্রিয় গান–
‘সময় যেন কাটে না
বড় একা একা লাগে
এই মুখর জনারণ্যে
বিরহী বাতাস বহে
শুধু তোমার জন্য ’
পিলু খানের সুরে গানটি গেয়েছেন সামিনা চৌধুরী। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এমন মুহূর্ত কিন্তু আসে। তখন বেশ ভাবনা তৈরি হয়। অস্থিরতা কাজ করে। চঞ্চলতা ভর করে। মানসিক এমন টানাপোড়েনকে নিয়েই গান লিখেছেন জঙ্গী ভাই। যা আজও কানে বাজে।
এভাবেই গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের কর্ডসহ পঞ্চাশ গানের বই ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে ’। আরো ভালো লাগার বিষয়– প্রত্যেক গানের সাথে আছে অলংকরণ। গানের বিষয়ের সাথে মিল রেখে। পাঠককে আকৃষ্ট করেছে সহজেই। যারা শুদ্ধ গান করতে চান, শুধু শুনে নিখুঁতভাবে গাওয়া সম্ভব অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠে না। তাঁদের জন্য এই বইটি অবশ্যই বিশেষ ভূমিকা রাখবে। কারণ, শুদ্ধভাবে গাওয়া ও সুর অবিকৃত রেখে গাওয়ার মাঝেই একটি গানের স্থায়ীত্ব নির্ভর করে। আমাদের আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে দিলেন গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাই। এজন্য তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।