বই দিয়ে জাগাতে হবে শিশুদের : এম এ মালেক

স্বপ্ন দেখার একটি উপকরণ বই : পবিত্র সরকার শেখ রাসেল বইমেলা ও শিশুসাহিত্য উৎসব শুরু

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে ছয়দিনব্যাপী ‘শেখ রাসেল ছোটোদের বইমেলা ও শিশুসাহিত্য উৎসব’ গতকাল শুক্রবার থেকে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি ভবনে উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হয়েছে। বিকেল ৫টায় উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. পবিত্র সরকার। খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেনের সভাপতিত্বে উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম.এ মালেক।

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এম.এ মালেক বলেন, শিশুদের মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তাদের রয়েছে জানার স্পৃহা। এই জানার স্পৃহা জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। কেননা শিক্ষাই হলো মূল ভিত্তি। শিক্ষা অর্জিত না হলে আমরা কখনো পরিপূর্ণ মানুষ হবো না। আর শিক্ষা অর্জনের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

তিনি আরো বলেন, আমাদের অভিভাবকদের দায়িত্ব শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাদের মানবিকতার চর্চা ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে হবে। শিশুদের ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে না পারলে ভালো সমাজ তৈরি হবে না এবং সেটা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। বই পড়ার জন্য শিক্ষা দরকার। না পড়লে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে না। অনুষ্ঠানে ফুল দিলে আমি বলি বই দিতে। তাহলে বই পড়ার আগ্রহ জন্মাবে। মাবাবার দায়িত্ব সন্তানের মনে স্বপ্ন গড়ে দেওয়া। তাহলে শিশুরা বাকিটা করে নেবে।

শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে মাবাবা এবং শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বরেণ্য এ গুণীজন বলেন, অভিভাবকদের উচিত শিশুর মধ্যে একটি স্বপ্ন গেঁথে দেওয়া। তাদের মনে স্বপ্ন গেঁথে দিতে পারলেই সে জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেতে পারবে। পশু জন্মের পরই পশু। শিশুকে সমাজ পরিবার গাইড না করলে ভালো মানুষ হিসেবে সে গড়ে উঠবে না।

নিজেকে উদাহরণ হিসেবে গড়ে তোলা খুবই কঠিন কাজ উল্লেখ করে এম এ মালেক বলেন, আমাদের চেষ্টা করতে হবে যেন নিজেদের উদাহরণ হিসেবে গড়ে তোলা যায় এবং সবার মধ্যে সেই লক্ষ্যই থাকা উচিত। তিনি বলেন, আমরা সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। এর জন্য সরকার, সমাজ, শিক্ষক, অভিভাবক সবার দায়িত্ব আছে। এই পৃথিবীতে মাত্র তিনজন মানুষ আছেন যারা তোমার থেকে কোনো কিছু আশা না করে তোমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তারা হলেন, মাবাবা এবং তোমার শিক্ষক। মাবাবা, শিক্ষক কোনো বিনিময় ছাড়া একজন শিশুকে ভালোবাসে তার ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করেন। আমি সব সময় বৃদ্ধাশ্রমের বিপক্ষে। বাবামা আমাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন। মাদশ মাস দশদিন ধারণ করে আমাকে জন্ম দিয়েছেন। তাই মাবাবাকে কখনো অবহেলা করা যাবে না।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক আরো বলেন, পৃথিবীর সব কিছু পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতার সাথে আমাদের মানিয়ে চলতে হবে। ডাইনোসর শক্তিশালী হয়েও প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। কিন্তু মানুষ টিকে আছে। এই পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে যারা মানিয়ে চলতে পেরেছে তারা সফল হয়েছে।

তিনি বলেন, যেকোনো কাজে ভালো করে লেগে থাকলে পুরস্কারও পাওয়া যায়। আমার বাবা একুশের প্রথম কবিতা সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি ছাপিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ জেনেও। এর জন্য আমি গর্ব অনুভব করি। এর মধ্য দিয়ে একুশের সাথে স্বাধীনতার সাথে আমাদের পরিবার জড়িয়ে আছে।

বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক শিশু সাহিত্যিক আনজীর লিটন, সর্বভারতীয় সম্পাদক শিশু সাহিত্যিক আনসার উল হক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমির পরিচালক ও দৈনিক আজাদীর সহযোগী সম্পাদক শিশু সাহিত্যিক রাশেদ রউফ।

উৎসবের উদ্বোধক খ্যাতিমান সাহিত্যিক ড. পবিত্র সরকার বলেছেন, স্বপ্ন দেখার একটি উপকরণ বই। বই অনেক বড় বন্ধু। শিশুরা বই পড়ে স্বপ্ন দেখবে। স্বপ্ন সার্থক করতে প্রবল পরিশ্রম করতে হবে।

. পবিত্র সরকার বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছে সেটি শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর ইতিহাসে কলংকজনক অধ্যায়। সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি তারা ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করেছে। এটি জঘন্য কাপুরুষতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। শেখ রাসেলকে স্মরণ করে জীবনমুখী প্রয়াস এ বইমেলা। বাংলাদেশ নারী শিক্ষায় অনেকদূর এগিয়েছে। শিশুরাতো শিখছেই। শিশুর হাতে বই উঠলে তারা বিশ্বনাগরিক হবে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি শেখ রাসেলকে স্মরণে রেখে বইমেলার এই আয়োজনটুকু ইতিহাসে নতুন সংযোজন হলো। এটি অসাধারণ এবং স্বার্থক একটি উদ্যোগ। তিনি আরো বলেন, শিক্ষা যত বেশি ছড়াবে ছেলে মেয়ের হাতে তত বেশি বই উঠবে। বই পড়ার মাধ্যমে শিশুরা সারা পৃথিবীকে জানতে পারবে। দেশকে ভালোবাসতে শিখবে।

সভাপতির বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, শেখ রাসেল বিশ্ব শিশুর প্রতীক। ১৫ আগস্ট কাল রাতে শেখ রাসেল হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে লঙ্ঘিত হয়েছে বিশ্বমানবতা। পনেরোই আগস্ট অমোচনীয় কলঙ্কের দিন। ঘাতকরা কেবল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি একে একে হত্যা করেছে পরিবারের সদস্যদের। তাদের নির্মমতা থেকে রক্ষা পায়নি ছোট্ট রাসেলও। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে শেখ রাসেল বইমেলা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন। শিশুসাহিত্যকরা ছড়াকবিতা, গল্পউপন্যাসে শেখ রাসেলকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। শেখ রাসেলের আদর্শ আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।

তিনি বলেন, মানুষ একমাত্র জীব যারা প্রকৃতিকে বদলে দিতে পারে। প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে বদলাচ্ছে। প্রকৃতিকে ভালোবেশে একাত্ম হয়ে বিশ্ব গড়তে হবে। সভ্যতা মানে বই। শিশুসাহিত্য কল্পনার বিস্তার ঘটায়। শিশুরা বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলবে এ আশা রাখি।

শিশুসাহিত্যিক আনসার উল হক বলেন, শেখ রাসেল বইমেলা বিশ্বের বাংলাভাষী শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরি করেছে। চট্টগ্রামে প্রথম এসেছি, চট্টগ্রামের শিশুসাহিত্যিকদের এমন ভালোবাসা আজীবন মনে থাকবে। এমন একটি বইমেলায় অংশ নিতে পেরে খুবই আনন্দবোধ করছি। এ বইমেলা নিয়মিত হবে এ আশা রাখি।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক শিশুসাহিত্যিক আনজীর লিটন বলেন, শেখ রাসেল বাঙালির ইতিহাসের গর্বিত নাম। সে লাল সবুজের রাজপুত্তুর। স্বাধীনতার আগে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য খুব বেশি পায়নি রাসেল। রাসেলকে জানতে হলে প্রধানমন্ত্রীর লেখা বই পড়তে হবে। রাসেল বাবার সঙ্গে ঘুরতে পছন্দ করতো। পঁচাত্তরে বাবার সঙ্গে ঘাতকরা তার ছোট্ট বুকটি ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। সে মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যেতে দেয়নি। রাসেল কয়েকটি ছবির মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।

বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমির পরিচালক কবি সাংবাদিক রাশেদ রউফ বলেন, শেখ রাসেল বিশ্বের দুরন্ত রাজপুত্রের প্রতীক। পঁচাত্তরের কালোরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিশু রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ঘাতকরা। ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনকে ঘিরে দ্বিতীয় বারের মতো বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে শেখ রাসেল বইমেলার আয়োজন করেছি। শিশুদের বইমুখী করতেই আমাদের এ প্রয়াস।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় শিশু সাহিত্যিক বিপুল বড়ুয়ার সভাপতিত্বে শেখ রাসেলকে নিয়ে ছড়াকবিতা পাঠে অংশ নেন আহসানুল হক, উম্মে হাবিবা সূচনা, ক্যামেলিয়া আহমেদ, জাকির হোসেন কামাল, জোবায়দা আক্তার চৌধুরী, নাসরীণ রীনা, নুরনাহার ডলি, পাশা মোস্তফা কামাল, মালেক মাহমুদ, মাইছুরা ইশফাত, মেরিনা সুলতানা, রূপক কুমার রক্ষিত, শওকত জসীম, শাহনাজ পারভীন, সানজিদা আফরীন, হাসিনা আকতার।

সন্ধ্যা ৭টায় অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র সরকার সন্ধ্যা ‘ছড়া পড়ার ইচ্ছে আছে?’ বিষয়ে বই নিয়ে আলোচনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাহিত্যিক ড. শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক সুজন বড়ুয়া। রাত ৮টায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক রহীম শাহ’র সভাপতিত্বে ‘আমার লেখা আমার বই : শেখ রাসেল’ বিষয়ে সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন ইউসুফ রেজা, নেছার আহমদ, . . . মোদাচ্ছের আলী, মিলন বনিক, ইফতেখার মারুফ, রুনা তাসমিনা।

এদিকে উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে ড. পবিত্র সরকারের ‘ছড়া পড়ার ইচ্ছে আছে? রাশেদ রউফ ও মহসিন চৌধুরী সম্পাদিত জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধু, আজিজ রাহমানের রঙ লেগেছে পাতায় পাতায়, প্রদ্যোত বড়ুয়ার পেখম খুলেছে আলোর পাখি, লিপি বড়ুয়ার আলোর পাখি শেখ রাসেল, বনশ্রী বড়ুয়া সবুজ হাসে বাংলাদেশে, গৌতম কাননুগোর চাঁদের হাসি খোকার হাসি, সজল দাশের দিচ্ছে পাড়ি বনবাদাড়ি, ইসমাইল জসীমের সবুজের সাথে মন মাতাতে ও রুনা তাসমিনা সম্পাদিত অনন্যধারা।

বইমেলার আজকের কর্মসূচি : আজ শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। যাঁরা সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁরা হলেন অজয় দাশগুপ্ত, ফারুক হোসেন, আহসান মালেক, কেশব জিপসী, রমজান মাহমুদ। প্রধান অতিথি থাকবেন ড. পবিত্র সরকার। আলোচক থাকবেন কবিশিশুসাহিত্যিক তপংকর চক্রবর্তী।

এর আগে অনুষ্ঠিত হবে শেখ রাসেল আবৃত্তি প্রতিযোগিতা (খ বিভাগ) , শেখ রাসেলকে নিয়ে ছড়াকবিতা পাঠ, এবং আমার ভাবনায় শেখ রাসেল (১ম পর্ব)। এতে সভাপতিত্ব করবেন ড. প্রণব কুমার চৌধুরী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতত্ত্বাবধায়ক সরকার মরে ভূত হয়ে গেছে : কাদের
পরবর্তী নিবন্ধগাজায় ইসরাইলের স্থল অভিযান শুরু