বাংলাদেশি জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রণীত ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে আবার কড়াকড়ির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সমুদ্র বাণিজ্যে দেশের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনটি অমান্য করে কন্টেনার বোঝাই করায় লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী একটি কন্টেনার জাহাজকে দুদিন আটক করা হয়। ৭২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করার পর জাহাজটিকে বন্দর ত্যাগের ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
অবশ্য এই অ্যাক্ট নিয়ে বাংলাদেশের কড়াকড়িতে বিশ্বের নানা দেশের জাহাজ মালিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন দেশে চলাচলকারী কন্টেনার এবং রো রো ভ্যাসেল অপারেটরদের সংগঠন ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল (ডব্লিউএসসি) থেকে ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্টের কিছু ধারা ও শর্ত সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেওয়া হলেও বাংলাদেশ তাতে সাড়া দেয়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিদেশি জাহাজ মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে পাল্টা কোনো অবস্থান নেওয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
শিপিং সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশীয় পতাকাবাহী সরকারি–বেসরকারি জাহাজকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০১৯ নামের একটি আইন রয়েছে। ১৯৮২ সালে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অর্ডিন্যান্স হিসেবে থাকলেও পরবর্তীকালে তা আইনে পরিণত করা হয়। দেশীয় জাহাজশিল্পকে সুরক্ষা দিতেই আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের প্রেক্ষিতে বিদেশি জাহাজগুলোকে দেশের বন্দরের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বাংলাদেশি আমদানি–রপ্তানি পণ্য পরিবহন করতে আগেভাগে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার (পিও–এমএমডি) থেকে অনুমোদন বা ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) প্রিন্সিপ্যাল অফিসার বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এবং বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশনগোয়িং শিপ ওনার্স এসোসিয়েশনের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বন্দরে দেশীয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ নেই বা পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার সিডিউল নেই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিদেশি জাহাজকে উক্ত পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র বা ওয়েভার সার্টিফিকেট প্রদান করে। বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজ উপস্থিত বা ১৫ দিনের মধ্যে আসার সিডিউল থাকলে ওই পণ্য বিদেশি কোনো জাহাজ পরিবহন করতে পারে না।
এদিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো বিদেশি জাহাজ পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এলেও ফিরতি পথে ওয়েভার না পেয়ে পণ্য বোঝাই করতে পারে না বলে জানিয়েছেন বিদেশি জাহাজের এজেন্টরা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওয়েভার সনদ না নিয়ে পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য বিদেশি জাহাজগুলোকে জরিমানা গুণতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে শুধু বিদেশি জাহাজ মালিকদের সংগঠন নয়, দেশের তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকেও আইনের কড়াকড়ির ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে অরজিন টু অরজিন পণ্য পরিবহনের মধ্যে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট সীমাবদ্ধ রাখার জন্যও পরামর্শ দিয়েছিল।
লাইবেরিয়ার একটি জাহাজ থেকে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা আদায়ের পর বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টর আবার নড়েচড়ে বসেছে। শুধু একটি জাহাজ নয়, ওয়েভার সনদ নিয়ে সৃষ্ট সংকটে এর আগেও বিদেশি বেশ কয়েকটি জাহাজকে মোটা অংকের জরিমানাসহ নানা শাস্তির মুখে পড়তে হয়। ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল এই আইনের কড়াকড়ি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠনটির সিঙ্গাপুর অফিস থেকে আইনটির বেশ কিছু ধারা ও শর্ত শিথিল করার আহ্বান জানানো হয়। ১৫ দিন আগে সিডিউল দিয়ে ওয়েভার সনদ নেওয়ার প্রসঙ্গে পত্রে বলা হয়েছে, যেখানে ৩/৪ দিনের ট্রানজিটে পণ্য পরিবাহিত হয়, সেখানে ১৫ দিন আগে থেকে বলে সনদ যোগাড় করা অসম্ভব।
উল্লেখ্য, দেশের ৫০ শতাংশ পণ্য দেশীয় জাহাজ দিয়ে পরিবহনের লক্ষ্য নিয়ে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট করা হয়। কিন্তু বিএসসি কিংবা বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে জাহাজের সংখ্যা নগন্য হওয়ায় দেশীয় জাহাজ দিয়ে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পতাকাবাহী কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা সিঙ্গেল ডিজিট পার হতে পারেনি। অথচ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সাথে সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং পোর্ট কেলাং মিলে ৮০টির বেশি বিদেশি কন্টেনার জাহাজ চলাচল করে। এসব জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন না থাকলে সমুদ্রপথে আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য সামাল দেওয়া কঠিন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, ফ্ল্যাগ প্রোটেকটশন অ্যাক্ট বাংলাদেশ সংসদে পাশ করা একটি আইন। এটা মেনেই বিদেশিদের জাহাজ পরিচালনা করতে হবে। তারা কেউ আমাদের সাহায্য করতে আসে না, ব্যবসা করতে আসে। তাই ব্যবসা করতে হলে আইন মেনেই করতে হবে। আইনের কড়াকড়ি বলে কোনো কিছু নেই। প্রচলিত আইন মানতে হবে। আইন লংঘন করলে শাস্তি তো পেতে হবে।
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ দিয়ে পুরো ব্যবসা সামাল দেওয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুযোগ পেলেই তো আমাদের ব্যবসায়ীরা এই খাতে বিনিয়োগ করবেন। আইনটি করা হয়েছে দেশের জাহাজশিল্পের বিকাশের জন্য। নিশ্চয় ধীরে ধীরে দেশীয় জাহাজের সংখ্যা বাড়বে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আইনটি নিয়ে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এমভি এঙপ্রেস লোৎসে নামের একটি জাহাজকে দুদিন আটকে রাখা হয়। পরে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করার পর জাহাজটিকে বন্দর ত্যাগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ৪৫০ টিইইউএস রপ্তানি পণ্যবোঝাই কন্টেনার নিয়ে গত ১৫ মে বিকালে জাহাজটি কলম্বোর পথে যাত্রা করার কথা ছিল। কিন্তু ওয়েভার ইস্যুুতে জাহাজটিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ৭২ লাখ টাকা জরিমানা আদায়ের পর ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট সি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওয়েভার ইস্যু নিয়ে জাহাজকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু জাহাজ আটকে রাখার ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেনি। জাহাজটিকে আটকে রাখায় এটি ক্ষতির মুখে পড়েছে। জাহাজটিতে থাকা ১,৪৫০ টিইইউএস রপ্তানি পণ্য কলম্বো বন্দরে নিয়ে ইউরোপ–আমেরিকাগামী মাদার ভ্যাসেলে তুলে দেওয়ার সিডিউল ছিল। ওই সিডিউল মিস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় জাহাজটি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। এতে দেশের কয়েক কোটি ডলারের রপ্তানি পণ্যও ঠিকভাবে ইউরোপ–আমেরিকায় পৌঁছানোর ব্যাপারে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের এই আইনের কড়াকড়ির কারণে ইতোমধ্যে ৫টি জাহাজ চট্টগ্রাম রুট থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ দিয়ে সমুদ্রবাণিজ্যের ৫০ শতাংশ সামাল দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের সব পণ্য পরিবহন করতে ৯০টি ফিডার ভ্যাসেল লাগে। অথচ বাংলাদেশের একটি বেসরকারি শিপিং কোম্পানির মাত্র ৮টি কন্টেনার জাহাজ রয়েছে।
মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) শীর্ষ একজন কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, লাইবেরিয়ান জাহাজটি ইতোপূর্বে আইন লংঘন করেছিল। তাদেরকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়। ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন আইন না মানার কারণে এই জাহাজের এজেন্টকে জরিমানাও করা হয়েছিল। তিনি বলেন, তারা আগের জরিমানা পরিশোধ করেনি। বরং নতুন করে অনিয়ম করেছে। তাই জাহাজটিকে আটক করে সব জরিমানা একসাথে আদায় করে বন্দর ত্যাগের অনুমোদন দেওয়া হয়।