সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে কিডনি ও লিভার বেচাকেনায় সক্রিয়। দেশ থেকে ডোনার সংগ্রহ করে ভারতে পাঠায় তারা। চক্রের সদস্যদের কেউ ‘কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন’ এমন বিত্তশালী রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে, কেউ প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ও লিভার বিক্রিতে প্রলুব্ধ করে। গত ১ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘ফেসবুকে কিডনি ও লিভার বিক্রির ফাঁদ : প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার, খুলশীতে মূল হোতাসহ চক্রের ৩ সদস্য আটক’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কিডনি ও লিভার বিক্রির প্রচারণা চালিয়ে আগ্রহী করে তুলতো তারা ডোনারদের। টাকার লোভে পড়ে এমন ফাঁদে পা দিয়েছেন সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তাকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় কিডনি ডোনেট করার প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচারের চেষ্টা করছিল পাচারকারীরা। তবে শুধু সাইফুলই নন, এমন অনেক অসহায় লোকের কিডনি ও লিভার ভারতে পাচার করে আসছিল তারা। র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর চাঞ্চল্যকর এ তথ্য জানা যায়। গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় নগরীর খুলশীতে ইন্ডিয়ান ভিসা অফিসের সামনে থেকে পাচার চক্রের ৩ সদস্যকে আটক করে র্যাব-৭। আটকরা হল মোহাম্মদ আলী ডালিম (৩৫), মো. আতিকুর রহমান রনি (৩৬) ও মো. আলম হোসেন (৩৮)।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রায় ১৫ বছর আগে জয়পুরহাটের কালাইয়ে প্রথম কিডনি বিক্রির ঘটনা ফাঁস হয়। এর পর ‘মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারায় সরকার নির্ধারিত ফরমে অনুমতি গ্রহণ ও আত্মীয়তা সম্পর্ক যাচাইয়ের জন্য যাচাই কমিটি এবং দাতা-গ্রহীতার জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্ট্যাম্পে প্রদত্ত হলফনামা, স্থানীয় সরকারের প্রত্যয়নপত্র, নোটারি পাবলিক ছাড়াও মা-বাবার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট, স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে কাবিননামা ইত্যাদি প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। নিকটাত্মীয়রা সহজে কিডনি দান করছেন না। তারা ঝুঁকির বিষয়ে নিঃসন্দেহ নন। এ কারণে আইনের উদ্দেশ্য পূরণের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা থাকছেই। খোঁজ নিলে হয়তো জানবেন, দানকারীরা হরহামেশা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। পাঁচ লাখ টাকা পাওয়ার আশায় কিডনি দিয়ে হাতে সামান্য টাকাই পেয়েছেন- এমন ঘটনাও ঘটেছে। দালালচক্র আইনকে পাশ কাটিয়ে দেশের বাইরে, বিশেষ করে ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে কিডনি স্থানান্তরের ব্যবস্থা করছে।
গত বৃহস্পতিবার পরিচালিত অভিযানের বিষয়ে র্যাব-৭ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ বলেন, কিডনি ও লিভার পাচারকারী তিন সদস্যের মধ্যে রনি আন্তর্জাতিকভাবে এ কাজে সম্পৃক্ত। করোনা মহামারির কারণে এত দিন যারা প্রবাসে ছিলেন তাঁদের অনেকেই বর্তমানে দেশে ফিরে এসেছেন। এর আগে প্রবাসীদের অনেকেই বিদেশে যাওয়ার আগে বিভিন্ন জনের কাছে ধার দেনা করে গেছেন। দেশে ফিরে আর্থিক সমস্যায় পড়া এ ধরনের লোকদেরই মূলত তারা টার্গেট করেন। পাশাপাশি দরিদ্র লোকদেরও টার্গেট করেন তারা। বাংলাদেশে এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা ডালিম। ভারতে অবস্থান করা পাচারকারী চক্রের শাহিন নামে এক ব্যক্তি বাংলাদেশে রনি, আলমসহ অন্যদের মাধ্যমে কিডনি ও লিভারের ডোনার সংগ্রহ করে থাকেন। ডোনার সংগ্রহ করে তাদের ভারতে পাচারের ব্যবস্থা করে চক্রটির লোকজন।
র্যাব-৭’র জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়াজ মোহাম্মদ চপল বলেন, কিডনির ডোনারদের মোটা অঙ্কের অর্থের লোভ দেখিয়ে ভারতে পাঠানো হয়। এ জন্য তাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়াসহ সব ব্যবস্থা করে চক্রটির লোকজন। প্রতি কিডনি ডোনারের সঙ্গে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় মৌখিক চুক্তি হতো। আর চক্রটি কিডনি বিক্রির জন্য ভারতীয় এজেন্টদের কাছ থেকে নিত ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা।
আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, আমাদের দেশে এখনো মানুষ মানুষের বিপদে আপদে ছুটে যান, এখনো মানবিক আহ্বানে সাড়া দেন। তাই মানবিক কারণে কেউ যদি কাউকে অঙ্গ দান করেন, তাহলে তা দোষের হতে পারে না। কিন্তু যারা অবৈধ প্রক্রিয়ায় কিডনি ও লিভার বেচাকেনা করে এবং ফাঁদ পাতে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তাদের আইনের আওতায় এনে অবশ্যই শাস্তি প্রদান করা দরকার।