ফেলে আসা দিনের কথা

শাহেদা নাসরিন | সোমবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ

অনলাইন থেকে পাওয়া একটা মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে আমার মনটাকে অনেক বছরের পেছনে টেনে নিয়ে গেল। মনে পড়ে গেল তখন আমি সবে মাত্র অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী, নতুন পরিবেশ নতুন অভিজ্ঞতা প্রতিদিনের ক্লাস শেষে যাওয়া আসার ক্লান্তি, এরমধ্যেই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লাম, রাতে প্রচণ্ড পেট ব্যথা তার সাথে অবিরাম বমি। এক দুপুরে হঠাৎ আমার ডাক্তার মামা (ডা. শহীদুল্লাহ) যিনি আমাদের রোগে শোকে বিপদে আপদে সবসময় সবকিছুতেই পাশে ছিলেন উনি আমাকে দেখতে এলেন, আমাকে দেখেই গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সাথে একজন ডাক্তারকে নিয়ে ফিরে এলেন। মামা যাকে নিয়ে এলেন উনি খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন, সব দেখে উনার হয়তো সুবিধের মনে হয়নি, উনি মামাকে বললেন এখুনিই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, অনেক দেরী হয়ে গেছে। শুনে আম্মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন কিছুতেই উনি হাসপাতালে মেয়েকে পাঠাবেন না। কান্না জড়ানো গলায় মামাকে বললেন, ‘মেজ ভাই মেডিকেলে গেলে আমার মেয়ে আর বাঁচবে না, লাশ হয়ে ফিরবে, আমি কিছুতেই দিব না’। আম্মার কান্না শুনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সান্তনার সুরে আম্মাকে অভয় দিলেন, ‘আমি আছি তো, শহীদুল্লাহ সাহেবের ভাগ্নী মানে আমার ভাগ্নী, আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন সব ঠিক হয়ে যাবে’। শুরু হলো মেডিকেলে যাবার আয়োজন, সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে। অন্যরকম অচেনা এক জগতে প্রবেশ করলাম। ওটি ভর্তি সাদা এপ্রোন পরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, আত্মীয় ডাক্তার, ইন্টার্নী ডাক্তার, থার্ড ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীরা। ফ্যাকাশে চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম মনে হলো সাদা পোশাকে আমার চারপাশে একঝাঁক দেবদূত দাঁড়িয়ে খুব নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এনেসথেসিয়া দেয়ার পর গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেলাম। এরমধ্যে কি ঘটে গেল কিছুই জানি না। মাঝরাতে চোখ মেলে কোথায় আছি বুঝার আগেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে যখন পুরোপুরি হুঁশ ফিরে এলো দেখলাম দেখলাম সুঠামদেহী কঠিন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ চারপাশে একদল ছাত্র ছাত্রী পরিবেষ্টিত হয়ে ওয়ার্ডের মূল দরজায় দাঁড়িয়ে। তখন কয়েকজন ছাত্রী এসে আমার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ালো। বললো, ‘তুমি অনেক ভাগ্যবতী, তোমার এপেন্ডিক্স এতো খারাপ অবস্থায় গিয়েছিল অপারেশনের পর কেটে প্লেটে রাখার পরপরই ওটা বার্স্ট করেছে। স্যার অনেক যত্ন করে তোমার অপারেশন করেছেন, আর কিছুক্ষণ দেরী হলে তোমাকে বাঁচানো কষ্ট হয়ে যেতো’। তখনই জানতে পারলাম আমার এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়েছে।
১৯৭৬ সালের ১০ই নভেম্বর স্রষ্টার অসীম দয়ায় এবং একজন দেবদূত তূল্য মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমার জীবনের আয়ু রিনিউ হয়েছিল বলে আজও আমি এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে আছি। কী অদ্ভুত ভাবে এত বছর পর এই ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৯ টায় আমেরিকায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন আমার নতুন জীবন ফিরিয়ে দেয়া সেই দেবদূত। দোয়া করি আল্লাহ উনাকে জান্নাতে শান্তিতে রাখুন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপকারী বন্ধু ভেলিভারি ম্যান
পরবর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ : বিশ্বপ্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা কতটা জরুরি