বাঁশখালীর গন্ডামারায় নির্মিতব্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। গতকাল শনিবার সকালে এস আলম গ্রুপের বাস্তবায়িত ১৩২০ মেগাওয়াট এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে এ ঘটনা ঘটে।
২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন, চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জায়গা অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হয়েছিলেন। ওই সময় বেশ কিছুদিন ধরে ওই এলাকায় স্থানীয় এক বিএনপি নেতার নেতৃত্বে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জায়গা অধিগ্রহণ নিয়ে আন্দোলন চলেছিল। গতকাল সেখানে ফের রক্ত ঝরল।
নিহতরা হলেন গন্ডামারা এলাকার আহমদ রেজা মীর খান (১৮), অলি উল্লাহর পুত্র রনি হোসেন (২২), নুরুজ্জামানের পুত্র শুভ (২৪), মো. ফালু মিয়ার পুত্র মাহামুদুল হক রাহাত (২৪) ও নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আদর্শ গ্রামের আব্দুল মতিনের ছেলে মো. রায়হান (২৫)। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ৪ জন বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে এবং রায়হান মারা যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই শিলব্রত বড়ুয়া বলেন, আহত ১৪ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় ৬ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শফিউর রহমান মজুমদার বলেন, চারজনকে মৃত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে নিয়ে আসা হয়। হতাহতদের অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ ছিল বলে জানান তিনি।
জানা যায়, শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি-দাওয়া ছিল। এর মধ্যে ছিল মাসের শুরুতে ৫-১০ তারিখের মধ্যে বেতন, রমজানে বিকেল ৫টার মধ্যে ছুটি এবং রমজানে ইফতারের জন্য বরাদ্দ, যখন তখন ছাঁটাই বন্ধ, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের আইন অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করা ইত্যাদি। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গতকাল এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে শ্রমিকদের দাবি নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রকল্পের দায়িত্বরতদের অভিযোগ, শ্রমিক নিহত হওয়ার খবরে বিক্ষুদ্ধ জনতা ও শ্রমিকরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে গাড়িসহ বেশ কিছু মালামাল পুড়িয়ে দেয়। প্রকল্পের জিনিসপত্রও নিয়ে যায়।
আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বাঁশখালী হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চাম্বল ন্যাশনাল হাসপাতালে ৭ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রেফার করা হয়। চাম্বল ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন মোরশেদ (২২), খোরশেদ (১৯), ইমন (২০), অভি (২২), রেজাউল (২৩) রাজুউল (২৩), সাকিব (২০) শামীম (৩০) প্রমুখ। বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে চিকিৎসা নেন পুলিশ সদস্য আবদুল কাদের (২৫), মো. আসাদুজ্জামান (২৪), ইয়াছির আজাদ (২৪), রাজা মিয়া (২৫) তোফাজ্জল (২০), আবু ছৈয়দ (২০), জোবাইদা আক্তার (২১) শিমুল (২৩) শাকিল (২৩), বেলাল আহমদ (৪৫), মিজানুর রহমান (২২) ও হাবিব উল্লাহ (১৯)।
এদিকে হাবিব উল্লাহ (২১), মো. রাহাত (৩০), মিজান (২২), মো. মুরাদ (২৫), মো. শাকিল (২৩), মো. কামরুল (২৬), মাসুম আহমদ (২৪), আমিনুল হক (২৫), মো. দিদার (২৩), ওমর (২০) অভি (২২) ও গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্য ইয়াসির (২৪), আব্দুল কবির (২৬) ও আসাদুজ্জামানকে (২৩) চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের শ্রমিক নেতা মো. হাবিব বলেন, রমজান আসার পর আমাদের কর্মঘণ্টা ২ ঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া, ইফতারের সময় এবং শুক্রবার অর্ধেক করাসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে শুক্রবার তারা ৫ জন প্রতিনিধি দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেন। তাতে কোনো সুরাহা না হলে শনিবার কাজে যোগদানের আগে সকাল ৮টা সাড়ে ৮টার দিকে শ্রমিকেরা এর প্রতিবাদ জানান। তা নিয়ে শ্রমিক ও প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা পুলিশ, আনসারের সাথে সংঘর্ষ হয়। এতে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
এস আলমের পক্ষ থেকে দায়িত্বে থাকা প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমদ বলেন, ঘটনার পর প্রকল্পের অভ্যন্তরে অনেক মালামাল ও জিনিসপত্র পোড়ানো হয়েছে। তার তালিকা তৈরি করা এখনো সম্ভব হয়নি। ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে প্রকল্পের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ সফিউল কবীর বলেন, পাওয়ার প্ল্যান্টে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সংঘর্ষ হয়। গোলাগুলির ঘটনায় বাঁশখালীতে ৪ জন এবং চমেক হাসপাতালে ১ জন মারা যায়। বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। তারা বর্তমানে চমেক ও বাঁশখালী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি-দাওয়া ছিল। এসব তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিতে চাচ্ছিল। শনিবার সকালে অসন্তোষ বাড়তে থাকে এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে স্থানীয় লোকজনও জড়িয়ে পড়ে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি : বিডিনিউজ জানায়, শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও বামপন্থী দল। বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন (স্কপ) এক বিবৃতিতে বলে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে শ্রমিকরা দাবি জানিয়ে আসলেও মালিকপক্ষ বরাবর এড়িয়ে গেছে এবং তাদের ওপর নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। আজ তাদের ন্যায্য বেতন-বোনাসের দাবিতে আন্দোলনের এক পর্যায়ে মালিকপক্ষ তাদের ওপর চড়াও হয়।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি) এক বিবৃতিতে বলে, বকেয়া বেতন-ভাতাসহ কতিপয় দাবিতে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি না মেনে কোনো যৌক্তিক সমাধান না করে এহেন হত্যাকাণ্ড চালিয়ে শ্রমিকদের দমন করার অপচেষ্টা রুখে দিয়ে হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এক বিবৃতি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে নিহত শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করার দাবি জানান। ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।
তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে গণসংহতি আন্দোলন। গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রাম জেলার আহ্বায়ক হাসান মারুফ রুমী ও সদস্য সচিব ফরহাদ জামান এক বিবৃতিতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করে দোষীদের বিচার ও শাস্তি এবং নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।