ফুলের সৌরভ

নাসের রহমান | শুক্রবার , ১২ জুলাই, ২০২৪ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

সৌরভ সারা মাস অপেক্ষায় থাকে কখন অনুষ্ঠানটি হবে। কখনো মাসের মাঝামাঝি সময়ে হয়, কখনো শেষের দিকে। আবার কোনো মাসে দু’টোরও সুযোগ হয়ে যায়। আলোচনা কিংবা সংবর্ধনা যে কোনো অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার একটা সুযোগ হয়। কখনো শুরুর দিকে আবার কখনো অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কবিতা পাঠ চলে। এতে কখন ডাক পড়ে ঠিক নেই। প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকতে হয়। কোন সময়ে ডাক পড়তে ঘণ্টা পার হয়ে যায়। কবিতাটা পকেট থেকে বের করে কয়েকবার দেখে নেয়। নিজের লেখা কবিতা, অনেকটা মুখস্থ। তবুও বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। আরেকটু দেখলে মনে হয় পড়াটা আরো ভালো হবে। কবিতা লেখার চেয়ে পড়তে আনন্দ বেশি। যতবার পড়া যায় ততবার ভালো লাগে। মনের ভেতরটা এক ধরনের আবেগ আচ্ছন্নতায় ভরে যায়। লেখার সময়ের যে ভাবনাকষ্ট তা আর মনে থাকে না। একসময়ে কবিতা কোথাও ছাপা হলে মনটা আনন্দে ভরে উঠতো। নিজে অনেকবার পড়তো। পরিচিত জনদের পড়ে শোনাতে ইচ্ছা করতো। কখনো কখনো পত্রিকাটা এরকম কারো হাতে তুলে দিতো। কবিতা একবার পড়ে দেখে বলতো ‘ভালো হয়েছে’। এ শব্দ দু’টো মনের ভেতর গেঁথে যেতো। আরেকটি কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা যোগাতো। কবিতা লেখা এতো সহজ নয়। অনেক ভেবে চিন্তে কবিতার লাইন তৈরি করতে হয়। দিনের পর দিন অপেক্ষা করে একটি লাইনের সাথে আরেকটি লাইন মিলানো হয়। পঙ্‌ক্তিমালা তৈরি করা হয়। একটি শব্দ আরেকটি শব্দের পাশে বসে কেমন যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কবি নিজের ভাবনাকে খুঁজে ফিরে এসব শব্দমালায়। আবার পাঠকের কাছেও পৌঁছাতে চায় নিজের ভাবনাকে। সব যে কবিতা হয়ে উঠে তা নয়। তারপরও থামে না। একের পর এক লিখে যায়। পাঠকেরা কিভাবে দেখলো তা নিয়ে কবির তেমন ভাবনা নেই।

কবিরা অনেক দিন কবিতা লিখে কবি পরিচিতি পায়। সৌরভকেও অনেকে কবি বলে ডাকে। এ নামে ডাকলে তার ভালো লাগে। প্রথম দিকের কবি কবি ভাবটা পরে আর ওভাবে থাকে না। কবিরা প্রায় ঘোরের মধ্যে থাকে, ভাবের জগতে বসবাস করে। এ জগতটাতে আনন্দের চেয়ে কষ্টই বেশি। অনেক সময় আনন্দ বলে কিছু থাকে না। তারপরও কবিরা এখান থেকে বের হতে পারে না। বের হতে চাইলে শূন্যতা আর হাহাকার তার ভেতরটাতে বাসা বাঁধতে থাকে। এজন্য কবিতার মোহ মায়া কেউ ছাড়তে পারে না। সৌরভ ছাড়বে ছাড়বে করে আর ছাড়তে পারেনি। এটার পর আর লিখবে না। এটাই শেষ কবিতা। এরকম অনেকবার হয়েছে। কিন্তু থামা যায়নি। কবিতায় থেকে গিয়েছে। কবিতা তাকে আটকে রেখেছে। কবিতার মাঝে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে পেয়েছে। মনের সাথে ভাবনার সাথে কবিতা মিশে গিয়েছে। এর থেকে বের হওয়ার কোন পথ নেই ।

সৌরভের আজকের কবিতা পড়া ভালো হয়েছে। কবিতা শুনে সবাই হাততালি দিয়েছে। তালির ধরন দেখে বুঝতে পারে। আবার পড়ার সময়ও বুঝা যায় দর্শক শ্রোতার মনোযোগ কেমন। এখানে যারা আসে তারা কিছু না কিছু লিখে। কেউ কেউ ভালো আবৃত্তি করে আবার কেউ গানও করে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে কবিতা গান এসব চলতে থাকে। আবৃত্তি যারা করে তারা অন্যের কবিতা পড়ে শোনায়। শুনতে ভালো লাগে। যার কবিতা তার কণ্ঠে এতো ভালো লাগে না। তবুও নিজের লেখা কবিতা নিজে পড়ার মধ্যে আলাদা আমেজ থাকে। কোনো কোনো কবিতায় লেখক পাঠক শ্রোতা একাকার হয়ে যায়। তখন অন্যরকম এক আবহ তৈরি হয়। অনুষ্ঠানটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দুই আড়াই ঘণ্টা সময় এভাবে কেটে যায়। এতো বছর পর কবিতার মাঝে নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। সব সময় যে খুঁজে পায় তা নয়। এ না পাওয়ার মাঝেও এক ধরনের তৃষ্ণা। সে তৃষ্ণা আবার নতুন কোনো ভাবনার কাছে নিয়ে যায়।

অনুষ্ঠান শেষে বের হয়ে সৌরভ ধীরে ধীরে রাস্তায় নেমে আসে। এসময়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে যেতে থাকে। কদম মোবারক মসজিদ ফেলে চেরাগী পাহাড়ের দিকে আসে। কত কথাই না মনে পড়ে যায়। কতো পুরানো এসব জায়গা, তারপরও কখনো কখনো অচেনা মনে হয়। দিনে দিনে শুধু বদলে যাচ্ছে। অনেক ফুলের দোকান পেরিয়ে ডিসি হিলের কাছে চলে আসে। এতো ফুলের দোকান কি করে চলে। ফুল পছন্দ করে না এমন কেউ নেই। তবে অনেকে ফুল কিনে না। এসব দোকানে তরুণ তরুণীদের আনাগোনা বেশি। মেয়েদের অনেকে ফুল দিয়ে সাজতে চায়। কোনো উপলক্ষ হলে এদের মাথায় ফুল শোভা পায়। এখন যে কোন অনুষ্ঠানে ফুলের প্রয়োজন হয়।

একটা মেয়ে ফুলের দোকানের সামনের ফুটপাত ধরে হাঁটছে। ধীর পায়ে হেঁটে চলছে। একে কেউ দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এ নাকি সুযোগ পেলে ফুল চুরি করে। কেউ বকাঝকাও দিচ্ছে। ‘এখানে দাঁড়ায়ে কি দেখছে, যাও তাড়াতাড়ি যাও।’ মেয়েটি কোন প্রতিবাদ করছে না। মাঝে মাঝে ফুলের গন্ধ নিতে চায়। আবার হাঁটতে থাকে। এসব ফুলেতো গন্ধ নেই, সৌরভও নেই। আছে শুধু সৌন্দর্য, নজর কাড়া সৌন্দর্য। ফুটপাতে ঝরে পড়া দু’একটি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে সে নাকের কাছে ধরে, ঘ্রাণ নিতে চায়। না, কিছুই পায় না ।

দোকানির চেঁচামেচি শুনতে পায়। ‘যাও এখান থেকে সরে যাও।’ মেয়েটি এখানে নাকি প্রতিদিন আসে। দোকানের সামনে ঘোরাঘুরি করে। প্রথম দিকে ফুল ধরে ধরে দেখতো। পরে দোকানি আর ফুলে হাত দিতে দেয় না। তারপরও ফুলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে । দেখে দেখে মনে মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলে। ‘আহা আমি যদি ফুল হতাম, সবাই কত না ভালবাসতো আমায়।’ আরেক দোকানের সামনে গিয়ে বলে, ‘দোকানে আমাকে আমাকেও ফুলের সাথে সাজিয়ে রাখতো।’ একটু থেমে আবার বলে, ‘কতজন এসে নড়াচড়া করতো। কেউ কিনে নিয়ে যেতো, কোথাও না কোথাও শোভা পেতাম। মেয়েটির এসব কথা দোকানিরা কেউ বুঝে না। সে অনেকটা মুখের ভেতর আওড়ায়। দোকানির কান পর্যন্ত পৌঁছে না। তারপরও তারা কিছু কিছু অনুমান করে বলে, ‘কোথাও বড় রকমের দাগা খেয়েছে মেয়েটি’ আবার কেউ বলে, ‘পাগলে কত কিছু বলে, পাগলের প্রলাপের শেষ নেই।’ আরেকজন বলে, ‘এতো ভিক্ষা নেয় না, চলে কি করে। তবে ফুল দিলে খুশি মনে নাকে ঘ্রাণ নিতে চায়’ কেউ আবার খারাপ মন্তব্য করে, ‘মনে হয় ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়’। এসব কথায় মেয়েটি ভ্রুক্ষেপ করে না। ফুলের দোকানে কর্মচারী ছেলে ছোকড়া তাকে কোথাও দাঁড়াতে দেয় না। নানা কথা বলে ক্ষেপাতে চায়। তার নামে কুৎসা রটায়। মেয়েটি এসব পোলাপাইনকে পাত্তা দেয় না। কারো কথায় তার কিছু যায় আসে না। সে নিজের মতো করে চলতে থাকে।

মেয়েটিকে দেখে সৌরভ থমকে দাঁড়ায়। দেখলে মনে হয় না পাগল। মতিভ্রম হয়ে থাকতে পারে। অথবা কোন আপনজন থেকে এমন আঘাত পেয়েছে যা সইতে পারে নি। মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আবোল তাবোল বকতে থাকে। মেয়েটির পরিবারের কি কেউ নেই। এমন বয়সের একটি মেয়ে রাস্তায় ফুলের দোকানের সামনে ঘুরে বেড়ায় তা কি করে হয়। আর যার যা কিছু মুখে আসে তা বলে যায়। কারো কি বিবেক বলে কিছু নেই । কারো কি মায়া মমতা হয় না। আসলে মেয়েটি কি চায়, তাও কেউ বলতে পারে না। সবাই বলে ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্য কারো দিকেতো তাকায় না। ফুলের মাঝে কি দেখে সে। দেখার চেয়ে কি যেন খুঁজে। কেউ ফুল দিলে অনেক খুশি হয়। এ ফুলের সাথে তার কোন একটা কিছু জড়িয়ে আছে। যা সে কখনো ভুলতে পারছে না। ফুলকে নিয়ে তার দুঃখ আনন্দের করুণ কান্না মাখা কাহিনী আছে যা কেউ জানে না। মেয়েটিও কাউকে বলতে পারছে না। বললেও শোনার মতো কেউ নেই। এসময়ে কার কথা কে শুনে। আবার একটা পাগল মেয়ের কথা কে বা শুনতে পারে ।

কত ধরনের পাগলামি যে মানুষ করে তা কি করে বুঝায়। কম বেশি পাগলামি সবাই করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে না। মাত্রা বেড়ে গেলে কখনো কখনো প্রকাশ পেয়ে যায়। অনেক ভালো লোককে মানুষ কথায় কথায় পাগল বলে ফেলে। অনেকে গায়ে মাখে না, কেউ আবার খুব মাইন্ড করে বসে। তখন ঝগড়া বিবাদও লেগে যায়। এমনকি লোকটি পাগলের মতো আচরণ করতে থাকে। কেউ পাগল বললে পাগল মনে করার কোন কারণ থাকতে পারে না। তবু পাগল ছাগল এসব কথায় মনের ভেতর নানাকিছু ঘুরপাক খায়। মানুষের মন কোথা থেকে কোথায় চলে যায় তার কোন ঠিক নেই। এসব সাত পাঁচ নিয়ে সৌরভ এমন ভাবনায় পড়ে যায় আর কুল কিনারা খুঁজে পায় না। ঘোরের মাঝে সময়টা কোন দিকে কেটে যায় টেরও পায় না। সৌরভের কি হলো, সে এসব কি ভাবছে। তার যখন সম্বিৎ ফিরে আসে তখন সে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। মেয়েটি কখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে সে টেরও পায় না। মেয়েটির দৃষ্টি একেবারে সহজ সরল। এরকম দৃষ্টি আর কখনো সে দেখেনি। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দাদা, আমাকে একটি সৌরভ মাখা ফুল দেবেন?’ সৌরভ তখন অবাক নয়নে মেয়েটির দিকে তাকায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা-উপভাষা ও চাটগাঁ ভাষা
পরবর্তী নিবন্ধবৈষম্যমূলক কোটার যৌক্তিক সংস্কার চায় রাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা