ছেলেটির নাম টুসু। সবাই টিসু বলে ডাকে। টিসু শব্দটা বহুল পরিচিত। এখন সর্বত্র এর ব্যবহার। এ নামে ডাকাও সহজ। ঘরের লোকজন ছাড়া বাইরের সবাই তাকে টিসু নামে ডাকে। এতে করে তার মন খারাপ হয় না। ভালোও লাগে না। প্রথম দিকে বলতে চেয়েছে, ‘আমার নাম টুসু’। কেউ তেমন একটা শোনেনি। কেউ আবার বলছে, ‘টুসু আর টিসু একই কথা। এক নামে ডাকলেই হয়।’ সেও আর কিছু বলতে চায়নি। টিসু নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ নামে ডাকলে ভালো খারাপ কোনোটাই আর লাগে না। এটা একটা ছেলের নাম হয়ে যায়। তবে বাবা-মা ভাই-বোনের কাছে সে টুসু থেকে যায়।
টুসু একটা ফুলের দোকানে চাকরি করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে দোকানে থাকতে হয়। সন্ধ্যা বললে ঠিক হবে না। রাত আটটার আগে কখনো সে দোকান থেকে বের হতে পারে না। বাসায় পৌঁছতে প্রায় সময় রাত নয়টা বাজে। এদিকে কোনো-কোনো দিন ভোরে দোকানে চলে আসতে হয়। বিশেষ দিনগুলোতে ভোরে ভোরে এসে দোকান খুলতে হয়। ভোর থেকে বিক্রি শুরু হয়। এসব দিনে ফুল বিক্রি খুব ভালো হয়। সকাল থেকে শুরু হয়ে বিকেল পর্যন্ত চলে। ফুলের তোড়া, ফুলের মালা, ফ্লাওয়ার বাকেট, পুষ্পস্তবক নানাভাবে বিক্রি হয়। রজনীগন্ধার স্টিক আর গোলাপফুল বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। ছেলেমেয়েরা এসব ফুল কিনে নিয়ে যায়।
ফুলের দোকানে কাজের শেষ নেই। নানা জায়গা থেকে ফুল আসে। বড় বড় ঝঁড়িতে করে আসে। খাঁচায় করে আসে। নেট জাতীয় বস্তায়ও ফুল আসে। বিভিন্ন রকমের ফুল বিভিন্ন দিক থেকে আসে। ফুলগুলো বাছাই করতে হয়। বড় ছোট মাঝারি ধরনের ফুলগুলো আলাদা করে রাখতে হয়। পাপড়ি ঝরে পড়া ফুলগুলো একজায়গায় রাখা হয়। আবার ঝরে পড়া পাপড়িগুলো আলাদা করে রাখা হয়। এসবও বিক্রি হয়ে যায়। তবে বাসি ফুল আর তাজা ফুল আলাদা করা যায় না। এখন তেমন আর থাকে না। দিনেরটা দিনে চলে যায়। কোনো কারণে থেকে গেলেও পরের দিন বিক্রি হয়ে যায়।
দোকানে ফুল সাজিয়ে রাখতে হয়। সামনের শোতে একরকম ফুল। আবার ভেতরে অন্যরকম ফুল। দেশি-বিদেশি নানা রঙের ফুল। বাহারি সব ফুল থরে থরে সাজানো থাকে। কোনো-কোনো ফুল তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। এসব ফুল হাতের কাছাকাছি রাখে। কোনো ফুলের দাম একটু বেশি, দেখতেও অনেক সুন্দর। এসব অর্কিড শোতে সাজিয়ে রাখে। দোকানের পেছন দিকেও অনেক ফুল থাকে। ফুল গাদাগাদি করে রাখা যায় না। খুলে রাখতে হয়। হাওয়া-বাতাস না লাগলে ফুল সতেজ থাকে না। পাপড়িগুলো কেমন যেন নুইয়ে যায়। ফুল যেখানে থাকুক যত্ন করে রাখতে হয়। সতেজ ফুলের সৌন্দর্য আলাদা। কোনো-কোনো ফুলে সৌরভ ছাড়ায়। সব ফুলে আবার সৌরভ থাকে না।
কোন ফুল দোকানের কোথায় শোভা পাবে আর কোথায় রাখতে হবে এসব টুসু জানে। বয়স কম হলে কী হবে, সে ফুলের দোকানের কাজ মোটামুটি ধরে ফেলেছে। ফুলক্রেতাদের দরদামও বলতে পারে। সে ছোট বলে অন্যরা তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। এটা ওটা ফরমায়েশ খাটাতে চায়। পান-সিগারেট আনায়। পাশের দোকান থেকে চা আনতে বলে। এসব কাজ করতে তার ইচ্ছা হয় না। তারপরও করতে হয়। ওদের কথা না শুনলে আবার দোকান মালিককে কী বলে বসে ঠিক নেই। মালিক প্রতিদিন বিকেলে একবার আসে। সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে দিনের হিসাব-নিকাশ করে চলে যায়। দুপুরের খাবার মালিকের বাসা থেকে আসে। সকাল বিকেলের চা-নাস্তা হোটেল থেকে হয়।
ফুল নিয়ে থাকতে চায় সে। সারাদিন ফুলের সাথে কাটাতে চায়। কিন্তু একে এদিক-ওদিক পাঠায়। রোদ-বৃষ্টি যাই থাকুক তাকে যেতে হয়। টোকাই ছেলেমেয়ে অনেক সময় ফুল চুরি করে। কয়েকটি পেলে কিশোরী মেয়েদের কাছে বিক্রি করে। এসব ফুল দিয়ে কিশোরীরা ফুলের তোড়া বা মালা তৈরি করে। রাস্তায় মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলে বিক্রি করতে চেষ্টা করে। দোকানের ফুল যেন টোকাইরা চুরি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখে টুসু। কয়েকবার হাতেনাতে ধরে ফেলেছে সে। এতে তার গুরুত্ব কিছুটা বেড়ে যায়। দোকানমালিকও তাকে অন্যদের মতো টিসু বলে ডাকে। মালিকের কাছে কোনো কিছু বলতে তার সাহস হয় না।
টুসুর বয়স এখনও দশ হয়নি। আট-নয়ের বেশি হবে না। মা কোনো সময়ে বলে আট বছর আবার কোনো সময়ে বলে নয় বছর। বাপের হিসাব আলাদা। বাপের কাছে ছেলের বয়স দশ-বারোর কম না। বয়স বাড়াতে পারলে কাজ পাওয়া যায়। কমবয়সী ছেলেদের সহজে কেউ কাজে রাখতে চায় না। নানা রকম ঝামেলা হতে পারে। এ বয়সে তাদের স্কুলে লেখাপড়া করার কথা। কাজ করার একটা বয়সসীমা আছে। এর কমবয়সী কাউকে কাজে নেওয়া অপরাধ। এর জন্য শাস্তি হতে পারে। জরিমানা হতে পারে।
সে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে। থ্রি থেকে ফোরে উঠেছে। ফোরেও কিছুদিন স্কুলে গিয়েছে। ফুলের দোকানে চাকরির পর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে স্কুলে যেতে চেয়েছে। মাও চেয়েছে।
বলেছে, আমি আরেক বাসায় বাড়তি কাজ করব। ছেলেকে স্কুল থেকে নামানো ঠিক হবে না। বাবা শোনেনি। বলেছে লেখাপড়া করে কী হবে। পরে চাকরিটা পাওয়া যাবে না। দুদিন পর তো আমার ভ্যানের পেছনে দৌড়াবে। মা বাপের সাথে পেরে উঠেনি। বাপ ভ্যান চালায়। কয়েক মাস আগে হাঁটুতে চোট পেয়েছে। হাঁটুর ব্যথাটা কোনোমতে সারে না। তারপরও ভ্যান নিয়ে বের হতে হয়। আরো দুজন ছেলেমেয়ে আছে। এরা এখনো ছোট। এদের খাবার জোগাড় করতে হয়। ঘরভাড়া দিতে হয়। ভ্যানটাও ভাড়ায় চালায়। সংসারের খরচ মিটিয়ে চিকিৎসার টাকা আর থাকে না।
দোকান থাকলেও টুসুর স্কুলের কথা মনে পড়ে। প্রথম কয়েক মাস খুব খারাপ লেগেছে। অন্যরা সবাই স্কুলে যাচ্ছে। সে দোকানে চলে এসেছে। ক্লাস শুরুর আগে ছেলেমেয়েরা সবাই কথা বলতো। একজনের কথা আরেকজন শুনতে না পেলে শব্দ করে বলতো। এভাবে শব্দগুলো একসাথে হলে একধরনের আওয়াজের মতো শোনাতো। সে আওয়াজটা এখনো তার কাছে বাজে। টিচার ক্লাসে ঢুকলে হঠাৎ আওয়াজটা থেমে যেতো। কেমন যেন সুনশান নীরবতার ভেতর সবাই ডুবে যেতো। সবার চোখ দুটি টিচারের মুখে দিকে। টিচারের দৃষ্টিও সবার দিকে। কেউ কিছু বলবে না, তারপরও টিচার বলছে, ‘চুপ’। এই যে চুপ হয়ে যেতো আর কথা বলতো না। টিচার ক্লাস থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত সবাই চুপ হয়ে বসে থাকতো। দোকানে বসে বসে এসব কথা ভাবে সে।
স্কুলের বারান্দার সাথে ছোট একটা মাঠ। কিছুটা লম্বাটে। ছুটির পর মাঠটিতে ছেলেমেয়েরা ছুটাছুটি করে। খেলাধূলাও করে। সেও মাঠের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে একবার আসতো আবার দৌড়ে যেতো। কয়েকজন মিলে এ দৌড় প্রতিযোগিতার অংশ নিতো। সে কখনো সবার আগে পৌঁছতে পারতো না। আবার সবার পেছনেও থাকতো না। মাঝামাঝিতে থাকতো। এ দৌড়া দৌড়ির মধ্যে তারা একধরনের আনন্দ খুঁজে পেতো। একজনের সাথে আরেকজনের গায়ের ধাক্কা লেগে পড়েও যেতো। তাড়াতাড়ি উঠে আবার দৌড় শুরু করে দিতো। এসব এখন তার অনেক বেশি করে মনে পড়ে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। তখন কোনো গ্রাহক দোকানে ঢুকলে সে তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পছন্দের ফুল খুঁজে দিতে চেষ্টা করে।
এখন চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে অনেক ফুলের দোকান। বেচাবিক্রিতে নানা রকম প্রতিযোগিতা। ফুলের দরদাম ঠিক করে বলতে হয়। না হলে ক্রেতা আসে না। এলেও অন্য দোকানে চলে যায়। টুসু সহজে যেতে দেয় না। কেউ ঢুকলে ফুল কিনে বের হয়। কোনো-কোনো কাস্টমার তাকে চিনে। তার নামও জানে। টিসু বলে তার সাথে কিছুটা তামাশাও করে। সে এতে মন খারাপ হলেও বুঝতে দেয় না। এদের ধরে রাখতে চেষ্টা করে। দোকানটির নাম ‘মালঞ্চ’। এ নামটিও অনেকের কাছে পরিচিত। ফুলের বাগানের নাম আর ফুলের দোকানের নামে কিবা এসে যায়। সবখানে ফুল থাকে। ফুলের সৌন্দর্য সবখানে একই রকম। তবে দোকানের ফুল নিষ্প্রাণ। পরের দিন বাসি ফুল হয়ে যায়।
উৎসব অনুষ্ঠানে ফুলের প্রয়োজন। ফুল না থাকলে যেন আনন্দই থাকে না। বিশেষ দিনগুলোতেও ফুলের বিক্রি ভালো হয়। পহেলা বৈশাখ ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় পরে ফুল কিনতে আসে। টুসুর খুব ভালো লাগে এদের কাছে ফুল বিক্রি করতে পেরে। তার ইচ্ছা এদের মতো রঙিন পাঞ্জাবি পরে ফুল নিয়ে মেলায় যেতে। ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখের অনেক বড় অনুষ্ঠান হয়। আগে সে গিয়েছে। এখন আর যেতে পারে না। দোকানের ভেতর দাঁড়িয়ে সকাল থেকে লোকজনের আসা-যাওয়া দেখে। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন অনেক ফুল বিক্রি হয়। দুপুরের পর ফুল আর থাকে না। ছেলেরা কালো পাঞ্জাবি আর মেয়েরা সাদা শাড়ি পরে শহিদমিনারে যায়। সবার বুকে কালো ব্যাচ আর হাতে ফুল থাকে। টুসু এসব নিয়ে তেমন ভাবে না। তার ফুল বিক্রি করতে পারলে হলো। সে খুব মন দিয়ে ফুল বিক্রি করে।
টুসুর মনটা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করলেও ফুলের সান্নিধ্যে তার ভালো লাগে। ফুলকে সে অনেক ভালোবাসে। ফুলের সৌন্দর্য তাকে আনন্দ দেয়। ফুলের বাগানে ঘুরতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু সে তো ফুলের দোকানে থাকে। যেখানেই হোক ফুলের মাঝেই থাকে। ফুলের সাথে থাকতে পারার মানেই হলো ফুলের সৌন্দর্যে ডুবে থাকা। সবাই এ রকম সুযোগ পায় না। টুসু পেয়েছে। ফুলের সাথে তার এক ধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। সে অনেক ফুলের নাম জানে। আবার ফুলগুলো চিনতে পারে, পাপড়ি দেখে বলে দিতে পারে, কোন ফুলের। এসব নিয়ে সে কখনো ভাবে না। ফুলগুলো দেখতে দেখতে তার কাছে অতি পরিচিত অতি আপন হয়ে ওঠেছে। সে নিজের অজান্তে ফুলের সাথে কথা বলে। মনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা, স্কুলের কথাও। ফুলের পাপড়ি মেলে টুসুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারাও দুঃখের কথা বলতে চায়। তাদেরও কষ্ট কম নয়। সবাই তাদের ছিঁড়ে ফেলে। তারা গাছে থাকতে চায়। ফুল গাছেই বেশি শোভা পায়।