জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় পানি শোধন করে সমুদ্রে ফেলার বিতর্কিত পরিকল্পনা নিয়ে ঘরে ও বাইরে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। জাপান এই পানি প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলার কাজ শুরু করতে যাওয়ার মধ্যে দেখা দিয়েছে এই উদ্বেগ।
কাজটি শুরু করতে জাতিসংঘ আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) অনুমতিও পেয়ে গেছে জাপান; যদিও চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং স্থানীয় কিছু অধিবাসী এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল।
দুই বছর আগে জাপান এই পরিকল্পনা ঘোষণার পর থেকেই সেদেশের জেলে এবং সামুদ্রিক খাবার ব্যবসায় নিয়োজিতরা–সহ ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে মানুষ জীবিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল। তাদের আশঙ্কা, তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ফেললে অনেকে সামুদ্রিক খাবার কেনা বন্ধ করে দেবে। জাপানের প্রতিবেশীরাও খুশি নয়। সবচেয়ে বেশি সোচ্চার চীন। তারা জাপানের বিরুদ্ধে মহাসাগরকে তাদের ‘ব্যক্তিগত নর্দমা’ হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ করেছে। খবর বিডিনিউজের।
গত মঙ্গলবার আইএইএ জাপানের পরিকল্পনা অনুমোদন করার পর চীন এই সংস্থাটির সমালোচনা করে বলেছে, তাদের এই সিদ্ধান্ত এক–পাক্ষিক। তবে আইএইএ বলছে, জাপান ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লির তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ছাড়ার যে পরিকল্পনা করেছে, তা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার মানদণ্ড অনুযায়ীই করা হয়েছে। এতে মানুষ ও পরিবেশের ওপর তেমন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না।
জাপান সরকার এবং ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাকারী কোম্পানি টেপকোও গবেষণা চালিয়ে এটা দেখানোর চেষ্টা করেছে যে, সাগরে ফেলা শোধন করা তেজস্ক্রিয় পানি মানুষ এবং সাগরের জীব–বৈচিত্র্যের জন্য তেমন ঝুঁকির কারণ হবে না। বিবিসি জানায়, টেপকো ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রর পানি অত্যাধুনিক তরল প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায় পরিশোধন করেছে। এতে পানির বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় পদার্থ কমে নিরাপত্তার মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আসলেও ট্রিটিয়াম এবং কার্বন–১৪ ততটা কমেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রিটিয়াম পানি থেকে আলাদা করা খুব কঠিন এবং এর মাত্রা বেশি থাকলেই কেবল তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ফলে সাগরে পানি ছাড়ার আগে এই ট্রিটিয়ামকে পাতলা করে বিপজ্জনক মাত্রার নিচে নামাতে হবে।
কিন্তু টেপকোর তেজস্ক্রিয় পানিশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে পরিবেশবাদী গোষ্ঠী গ্রিনপিসের কর্মীরা। তারা বলছে, পানি থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ কমাতে এই প্রক্রিয়া খুব বেশি কার্যকর নয়। জাতিসংঘ–নিযুক্ত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও তাই এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করছেন।
সমালোচকরা বলছেন, জাপানের বরং এখন এই শোধন করা তেজস্ক্রিয় পানি ট্যাংকেই রেখে দেওয়া উচিত। এতে করে পানি শোধন প্রক্রিয়া আরও উন্নত করার সময় পাওয়া যাবে এবং পানিতে যতটুকু তেজস্ক্রিয়তা আছে তা প্রাকৃতিকভাবেই কমে আসতে পারে।
চীন দাবি করেছে, জাপান শোধিত তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ছাড়ার আগে আঞ্চলিক দেশগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও চুক্তি করুক। আন্তর্জাতিক নৈতিকতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের জন্যও জাপানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে চীন। বলেছে, জাপান তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগুলে তাদেরকে এর সমস্ত পরিণতি ভোগ করতে হবে। টোকিও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় নিয়োজিত আছে। গত মে মাসে ফুকুশিমা কেন্দ্রে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষজ্ঞদের একটি টিমকে স্বাগতও জানিয়েছিল তারা। তবে পানি সাগরে ছাড়ার আগে প্রতিবেশী দেশগুলোর অনুমোদন পাওয়ার ব্যাপারে জাপান কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে সেটি এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সামপ্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশটির নাগরিকদের ৮০ শতাংশই ফুকুশিমার পানি সাগরে ফেলা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আবার দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্টও এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করে গতমাসে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। তাছাড়া, এ অঞ্চলের কয়েকটি দ্বীপদেশও প্যাসিফিক আইল্যান্ড ফোরাম আঞ্চলিক গ্রুপে জাপানের পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই পরিকল্পনাকে আরেকটি বড় ধরনের ‘পারমাণবিক দূষণ বিপর্যয়’ আখ্যা দিয়েছে তারা।
২০১১ সালের ১১ মার্চ ভয়াবহ এক ভূমিকম্প এবং এ থেকে সৃষ্ট সুনামির বিশাল জলোচ্ছ্বাসে জাপানের ফুকুশিমায় অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চারটি পারমাণবিক চুল্লি প্লাবিত হয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।