করোনা মহামারির মর্মান্তিক ছোবলও হানাহানির রাস্তা থেকে ইহুদিদের ফেরাতে পারেনি। পুঁজিবাদীদের নির্লজ্জ থাবা নিয়তই পাওয়া যাচ্ছে। ইহুদিরা একসময় নাৎসিদের হাতে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়েছিল, যা নির্মম ও বর্বর। ইহুদিদের নিজেদের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের যে কোনো জায়গাতে তারা পুনর্বাসিত হতে পারত। কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্ব তা হতে দিলো না। তারা ঠিক করলো তাদের আবাস হবে আরব ভূমিতে। তাই উৎখাত করো নিরীহ ফিলিস্তিনিদের । ফিলিস্তিনবাসী তাহলে কী অপরাধ করেছিলো? তাদের ভূমির প্রতি কেন ইসরায়েলিদের এত লোভ? ভাগ্যাহত ফিলিস্তিনিরা এর প্রতিবাদ করে দখলদার ইসরায়েলিরা মানতে চাইনি। কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্ব তা হতে দেয়নি। তাদের মানতে হলো। চেষ্টা হলো পরস্পর পরস্পরের পাশাপাশি থাকার কিন্তু তা আর হতে দিলো না ইসরাইলিরা। দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে গেলো তাদের নিত্য সঙ্গী। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে গড়ে ওঠে? আন্তর্জাতিক আইনে খুব কম বিষয়ই এমন দুর্বোধ্য। এভাবে ফিলিস্তিন কীভাবে রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে। এমন জটিল প্রশ্নও কমই আছে।
রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত অনেক ভূখন্ডই আছে যেগুলো কোনো শর্ত পূরণ করে না। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) নেতা ইয়াসির আরাফাত ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্সে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং এরপর তিনি ১৩০ টি দেশ তথা জাতিসংঘের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী সদ্যসের স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হন। তবে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার পথটিও রক্ত রক্ষাই রয়ে গেছে। ইহুদিদের রয়েছে তিনহাজার বছরের ইতিহাস। তবে এই ইতিহাস যতটা না ধর্মকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশী জাত ও বংশকেন্দ্রিক কর্তৃত্ব পরায়ণতার শক্তি প্রদর্শনের। জনসংখ্যায় অতিনগন্য হয়েও কোন অংশে তারা পিছিয়ে নেই। তাদের প্রসঙ্গ সামনে এলেই যেন বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিমের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক নানা দ্বৈরথ। গত কয়েকশো বছরের অসংখ্য ষড়যন্ত্র এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান নির্যাতন। যারা ছিল এক সময়কার সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি,তারাই আজ পৌঁছে গেছে নিপীড়কের নেতৃত্বে। গত মে মাসে টানা ১১ দিনের হামলায় শিশুসহ নিহত হয় আড়ই শতাধিক ফিলিস্তিনি। এরপর যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় উভয় পক্ষ। বিশ্বখ্যাত ফোর্ড মোটর কোম্পানির মালিক শিল্পপতি ও উদ্যোক্তা ১৯২০ সাল খেকে ইহুদিদের যাবতীয় ষড়যন্ত্রের ওপর একের পর এক তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করা শুরু করেন।এর ফলে তার পত্রিকার জনপ্রিয়তা খুবই দ্রুত ইউরোপ -আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্র এটি নিয়মিত পঠিত হতে শুরু করে। একসময় মি: হেনরি ফোর্ড থেমে যেতে বাধ্য হন। ফোর্ড ১৯১৯ সালের মে মাস হতে ‘দ্য ডিয়ারবর্ণ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকার মাধ্যমে ইহুদিদের নিপীড়নের বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লিখতেন। নিপীড়ক জাতির এসব তথ্য বহুল পঠিত হতো। পরে এসব বহুল পঠিত প্রবন্ধগুলো নিয়ে তিনি একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যেটি হেনরি ফোর্ডের বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ: ‘সিক্রেটস অব জায়োনিজম: বিশ্বব্যাপী জায়োনিস্ট ষড়যন্ত্রের ভেতর-বাহির’ নামে পরিচিত। তাতে তিনি ইহুদি জাতি গোষ্ঠী কীভাবে বিশ্বে এত প্রতাপশালী ভূমিকায় অবির্ভূত হলো তার অসংখ্য কৌতূহলউদ্দীপক তথ্য প্রমাণ দিয়েছেন। ফিলিস্তিানিরা আজ ইসরায়েলিদের হাতে নিপীড়িত ও নির্যাতিত এবং চিরকালের শরণার্থী। নিজ দেশে তারা আজ পরবাসী। অশান্তির কালো মেঘ যেন ফিলিস্তিনিদের আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছে চিরদিনের জন্য। রাশিয়ার বিশ্ববরেণ্য লেখক কাউন্ট লিও তলস্টয় বলতেন, ‘একজন প্রকৃত খ্রিস্টান তার প্রতিবেশীর সঙ্গে কোনো বিবাদে যায় না । সে কাউকে আক্রমণ করে না, হিংসার আশ্রয় নেয় না। সে কোনো প্রতিরোধ করে না, কষ্ট সহ্য করে নিজে’। মন্দ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি শুধু তাঁকেই মুক্ত করে না, একই সঙ্গে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সারা বিশ্বকে বাহিরের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করে। তলষ্টয় মনে করেন, যে সরকার মন্দ সে সরকারের অধীনে কোনো কাজ না করা বা আদেশ অমান্য করা উচিত হবে-তবে তা করতে হবে শান্তিপূর্ণ ভাবে। আমরা লিও তলষ্টয়ের বক্তব্যগুলোর মধ্যে বিষ্ময়করভাবে মানবিকতার চরম দিক গুলো খুঁজে পায়।আজ সাম্রাবাদীদের পোয়াবারো, ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের বর্বরতা হিটলারকেও হার মানায় ।এটার অন্তর্নিহিত কারণ হলো আরবদের অনৈক্য ও ব্যর্থ নেতৃত্বের পরাজিত ইতিহাস। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি হারানোর এবং স্বদেশ থেকে নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রনায় দগ্ধ দেশহীনতার বেদনার কথা তাঁর বিখ্যাত কবিতা’ জমজমাট গায়েবনার হাজিরায় তুলে ধরতে গিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘একদিন আমি হব পাখি, আর আমার নাস্তি থেকেই অস্তিকে ছিনিয়ে নেব/ যতই আমার দুই ডানা পুডতে থাকবে ততই সত্যের মুখোমুখি হব আমি, যেন ছাইভস্ম থেকে উঠছি আমি। স্বপ্নদ্রষ্টাদের কথোপকথন যেন আমি’। ফিলিস্তিনিরা হেরে যেতে পারে না, ওরা ছাই ভস্ম থেকেও উঠতে জানে। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইসরায়েলিদের মিথ্যা পরাজিত হবেই। ফিলিস্তিনির নারীবাদী কথা সাহিত্যিক সাহার খলিফার ‘দ্যা ইনহেরিটেন্স’ উপন্যাসের পটভূমি ১৯৬৭ সালের আরব ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনে জোরপূর্বক ইহুদিদের বস্তি স্থাপনের ফলে সৃষ্ট সংকটে ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগনের হার না মানা সংগ্রামের কাহিনি সত্য হয়ে উঠে আসে।
১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালে দুটি বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযানে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের বড় একটি অংশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। এসব ফিলিস্তিনি শরণার্থীর নিজ পূর্বপুরুষের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নটি ক্রমেই ক্ষীণহয়ে আসছে। মে মাসের ১১ দিনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর ২১ মে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধবিরতি হয়েছে। কিন্তু সে যুদ্ধবিরতি চুক্তি তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে গিয়ে আবারও গত ১৭ জুন ইসরায়েলের নির্বিচারে বিমান হামলায় জ্বলছে ফিলিস্তিনের শহর। এবারই প্রথম নয় আর এবারই শেষ নয়।এই যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয় আবার তা ইসরায়েল লংঘন করে। ২০০৯, ২০০১২ ও ২০১৪ সালেও এমন ধ্বংসযজ্ঞ শেষে অস্ত্র সংবরণ হয়েছে। এছাড়া সময়ে সময়ে গাজা থেকে রকেট নিক্ষেপ এবং তারপর ইসরায়েলি বোমা বর্ষণ একটি প্রচলিত ঘটনা। ২০১৪ সালে সাত সপ্তাহের যুদ্ধে ইসরায়েলের স্থলবাহিনি গাজায় অভিযান চালিয়েছিল। সে সময় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু এবারের শুরুটা হামাসের রকেট হামলা দিয়ে হয় নি। পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহ মহল্লা,যেখানে যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় কিছু ফিলিস্তিনি পরিবার বাস করে আসছে,তাদের বলপূর্বক উচ্ছেদ করতে যায় ইসরায়েলি বাহিনি, ইহুদিদের জন্য বসতি নির্মাণের লক্ষ্যে। তাই নিয়ে সংঘাত শুরু হয় ৩ মে থেকে। পরে ৭ মে আল আকসা মসজিদে পবিত্র জুমাতুল বিদার নামাজ পড়তে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের বাধা দেয় ইসরায়েলি পুলিশ, তাতেই সংঘাতের ব্যাপকতা বাড়ে। এর প্রেক্ষিতে ১০ মে রকেট-বোমার কারণে পাল্টাপাল্টি সংঘাত শুরু। বিশ্ববাসী এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডান ইসরায়েলের সমর্থক হিসেবে পরিচিত, তাই প্রথমে তিনি ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার আছে বলে বিবৃতি দেন, পরে ডেমোক্রেট পার্টির উদারপন্থীদের অভ্যন্তরীণ সমালোচনার মুখে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানান। পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ইসরায়েল। জনসংখ্যায় মিসর ও তুরস্কের সমান না হলেও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও পারমাণবিক অস্ত্রের জোর অনেক বেশী। সীমান্তের ভেতর ও অধিকৃত ফিলিস্তিন- দুই জায়গাতেই সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে এরা সমান পারদর্শী। ২০ লাখ ভূমির গাজার সব সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। গত নব্বুইয়ের দশকে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ ইহুদিও নতুন দেশে নিরাপদ থাকতে বদ্ধপরিকর। তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় এবং বর্তমান আরব বিশ্বের যে ভাঙ্গনের বাস্তবতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তার বিচার-বিশ্লেষণে বলা যায় স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন সুদূরপরাহত এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এমন একটা ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের লাখো খ্রীষ্টান জায়নবাদীরাও প্রচার করছে। ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটও বেশ ইহুদি কট্টরপন্থী। ফিলিস্তিনিরা যেটুকু আশা করেছিল বেনজামিন নেতানিয়াহু চলে গেলে কিছুটা অবস্থার পরিবর্তন হবে,এই নতুন ইহুদি কট্টরপন্থী বেনেটের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্যে দিয়ে সে আশায়ও গুড়েবালি। এই সংঘাত হয়তো আরো দীর্ঘতর হতে পারে। তারপরও কী শান্তির সুবাতাসের প্রত্যাশা আমরা করতে পারি না?
লেখক : প্রাবন্ধিক