সামীর–আল–মাসরী আমার ফিলিস্তিনি বন্ধুদের একজন। অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে ছিল তাদের বাপ–দাদার ভিটেবাড়ি। সেসবের কোনও চিহ্নই নেই। দখলদার ইসরাইল বুলডোজার দিয়ে তাদের গ্রাম–লোকালয় সব গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে ইহুদী বসতি স্থাপন করেছে। শিশুকালে উদ্ধাস্তু হয়ে পরিবারের সাথে এসে আশ্রয় নিয়েছিল জর্ডানে। বড় হয়েছে শরণার্থী শিবিরে। লেখাপড়া জর্ডানে। প্রকৌশল ডিগ্রি নিয়েছে মিশরের কায়রোর একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আশির দশকে আমি যখন জর্ডানে কর্মরত ছিলাম তখন আমার সহকর্মী ছিল। একই অফিসে আমরা কাজ করতাম। বছর দুয়েক একসাথে কাজ করতে গিয়ে আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠি। সহকর্মীদের মধ্যে ফিলিস্তিনি, জর্ডানি, মিশরী এবং মালয়েশিয়ান চায়নিজ বন্ধুও ছিল। প্যালেস্টাইন, পিএলও, ইয়াসির আরাফাত, আরব রাষ্ট্রসমূহের নতজানু পররাষ্ট্র নীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লীপনা ইত্যাদি নানা বিষয় আমাদের আলোচনায় উঠে আসত কাজের ফাঁকে, চায়ের আড্ডায়। আমি যখন দেশে ফিরে আসছিলাম তখন গভীর প্রত্যয়ে সামীর মাসরী বলেছিল হয়তো আবার দেখা হবে কোনওখানে, সে জর্ডানে বা বাংলাদেশে অথবা প্রিয়স্থান জেরুজালেমে। আমার ডায়েরির পাতায় তা লিখেও দেয় স্মারক হিসেবে। তার চোখে স্বপ্ন ছিল একদিন স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র হবে, নিজ দেশে নিজ জন্মভিটায় ফিরতে পারবে। সেটি ৩৮ বছর আগের কথা। মাসরীর সাথে আমার আর দেখা হয়নি, কোনওরকম যোগাযোগও হয়নি। জানি না কেমন আছে। বেঁচে আছে কিনা। তবে এটুকু জানি তার মত ফিলিস্তিনি উদ্ধাস্তুদের প্যালেস্টাইন নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন আরো ফিকে, আরও দুরূহ হয়ে পড়েছে।
সেই আশির দশকে জর্ডানে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ১০ লাখের মত ছিল। তা এখন প্রায় ২২ লাখের উপরে। তাদের অবস্থা খুবই মানবেতর হলেও অনেকেই ব্যবসা– বাণিজ্য করে, ভালো চাকরি–বাকরি করে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে তারা ছিল এবং আছে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হয়ে শরণার্থী হিসেবে। এরা ইসরাইলি পাস নিয়েও পশ্চিম তীরে যেতে পারে না সেখানে থাকা তাদের স্বজনদের সাথে দেখা করতে। জর্ডানের রাজধানী আম্মানে জর্ডান নদীর উপর কিং হোসেন ব্রিজ পেরিয়ে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা কাজের সন্ধানে জর্ডানে আসত ইসরাইল কর্তৃপক্ষের পাস নিয়ে। ঈদ–পরবের ছুটিতে তারা বাড়িতে যেত। আসা–যাওয়ার পথে ইসরাইলী পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একাধিক চেকপোস্টে তাদের পোহাতে হত নানারকম গঞ্জনা, নির্যাতন, নিপীড়ন। সহ্য করতে হত অপমান। সামীর আল মাসরীর মত সালেম ওয়ারদাত, রিয়াত হাফনাওয়াই, সালাহ্ এবং নাম ভুলে যাওয়া আরো অনেক ফিলিস্তিনি আমার সহকর্মী ছিল। তাদের মুখে ইসরাইলীদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও অপমানের করুণ কাহিনি শুনে মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। তাদের জিজ্ঞেস করতাম ইসরাইলী সামরিক ট্যাঙ্কের সামনে ইট–পাথর ছুঁড়ে তোমরা কিছুই করতে পারবে না জেনেও কেন এমন হটকারিতা কর। জবাবে তারা যা বলত তা শুনে লা জবাব হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বাবার সামনে ছেলেকে দিয়ে গাধার কাজ করানো, বা স্ত্রী সন্তানের সামনে গৃহকর্তাকে উলঙ্গ করে ইসরাইলী সেনা সদস্যের বুটে জমা ময়লা জিহ্বা দিয়ে পরিষ্কার করার মত ঘটনা দেখলে মাথা কি আর ঠিক থাকে?
২.
গত ৭ অক্টোবর গাজার মুক্তিকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরাইলে সাঁড়াশি হামলা চালিয়ে বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। অনেক ইসরাইলী নাগরিককে তারা আটক করে নিয়ে এসে জিম্মি করে রাখে। এরপর ইসরাইল বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। নাটের গুরু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে দেয় নগ্ন সমর্থন। ইইউসহ যে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনে নারী– শিশু হত্যা এবং বেসামরিক স্থাপনায় মিসাইল হামলার নিন্দায় সরব ছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটার পর একটা অবরোধ আরোপ করেছিল তারা এক্ষেত্রে উল্টো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। গাজায় নির্বিচারে গণহত্যায় তারা শুধু সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, সমরাস্ত্র ও অর্থের যোগান দিয়ে গণহত্যায় মদদও দিয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমাদের মদদে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে ইসরাইলী হার্মাদ বাহিনী। আবাসিক–অনাবাসিক ভবন, স্কুল–কলেজ, মসজিদ– গির্জা, হাসপাতাল–অ্যাম্বুলেন্স, কাঁচাবাজার–শপিংমল সর্বত্র যুদ্ধ বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে টনে টনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা–নাগাসাকিতে যে আনবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল তারচেয়েও বেশি ওজনের বোমা এরমধ্যে গাজায় ফেলা হয়েছে। ৩৫ দিনে গাজায় ৩২ হাজার টন বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। জল, স্থল ও আকাশপথে যুগপৎ হামলা অব্যাহত রয়েছে। গাজায় পানি, বিদ্যুৎ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ বন্ধ। অবরুদ্ধ গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দা চরম খাদ্য সংকটে। জ্বালানীর অভাবে হাসপাতালগুলিতে আলো জ্বলছে না। চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এক টুকরো রুটি, এক মগ পানির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেও ব্যর্থ হচ্ছেন গাজার মানুষ। প্রতিদিন লাশের সারিতে যুক্ত হচ্ছে নারী–শিশু–কিশোরসহ নিরীহ বাসিন্দারা। নিহতের সংখ্যা ১১হাজার ছাড়িয়েছে। গাজাকে ‘পৃথিবীর চিরস্থায়ী জাহান্নাম’ এ পরিনত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। শুধু গাজা নয়, পশ্চিম তীরও অশান্ত হয়ে উঠেছে। ইসরাইলী সেনারা সেখানেও হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। মুসলমানদের প্রথম কাবা হিসেবে পরিচিত মসজিদুল আল আকসায় মুসল্লীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটি খ্রিস্টানদেরও পবিত্র ভূমি। তাদের উপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ইসরাইলী দখলের কারণে পশ্চিম তীরের সাথে গাজার কোনও সংযোগ নেই। মাঝখানে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরত্ব, যা এখন ইসরাইলের অংশ।
২০০৭ সালে হামাস গাজার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তারা মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করে না। এই বিরোধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের জন্য প্লাস পয়েন্ট। তাই হামাসের হামলার অজুহাতে পুরো গাজা উপত্যকা এবার কব্জায় নেওয়ার মিশনে নেমেছে ইসরাইল। আরব রাষ্ট্রসমূহ এখানে নীরব দর্শক হয়ে তা দেখছে। কোনও দেশ আবার জিম্মি মুক্তির দূতিয়ালি চালিয়ে যাচ্ছে।
গাজায় গণহত্যা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশন হয়ে গেল। এতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘ইসরাইলে এক ভয়ংকর হামলা চালিয়েছে হামাস। তবে এ হামলা যে হঠাৎ শুন্য থেকে (কোনও কারণ ছাড়া) হয়নি এটাও সবাইকে বুঝতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারির শিকার। তাঁরা তাঁদের ভূখণ্ড দখল করে অবৈধ ইহুদি বসতি দেখেছেন। তাঁরা সহিংসতায় জর্জরিত হয়ে চলেছেন। গাজায় ইসরাইল যা করছে, তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা যেমন হামাসের ভয়ংকর হামলার ন্যায্যতা দিতে পারে না, তেমনি আবার এ হামলার জেরে জাতিগত ফিলিস্তিনি জনগণকে শাস্তি দেওয়া কখনো ন্যায্যতা পেতে পারে না।’
অ্যান্তেনিও গুতেরেসের বক্তব্যের পরপরই ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, গুতেরেস জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত নন। তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।
এ ঘটনার পর ইসরাইল জাতিসংঘ কর্মীদের ভিসা বাতিল করে। জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সহায়তাবিষয়ক প্রধানকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে ইসরাইলী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকও বাতিল করে।
নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব পাস হলেও ইসরাইল তা আমলে না নিয়ে গণহত্যায় আরও উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
এশিয়া মহাদেশের শেষ সীমানায় অবস্থিত গাজা উপত্যকা। গাজা থেকে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী মিশরে যাওয়ার পথও বন্ধ। রাফাহ্ সীমান্ত পার হলেই আফ্রিকা মহাদেশের শুরু। ফিলিস্তিনিরা দলে দলে শরণার্থী হয়ে যেতে যেন না পারে সেজন্য রাফাহ্ সীমান্ত বন্ধ রেখেছে মিশর। ত্রাণবাহী কিছু যানবাহন শুধু ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে ইসরাইলের অনুমোদনের ভিত্তিতে। জর্ডানের সীমান্তও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যেন আর কোনও শরণার্থী প্রবেশ করতে না পারে। ফিলিস্তিনি যারা যুগ যুগ ধরে আছে তাদের নিয়ে অস্বস্তির মাঝে আর কোনও ফিলিস্তিনি আসুক জর্ডান তা চায় না। জর্ডান এবং মিশর দুটিই ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্র। ইসরাইলের সাথে তারা কোনও বিরোধে জড়াতে চায় না বলে তারা নাখোশ হয় এমন কোনও পদক্ষেপ তারা নেবে না। জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘জর্ডানে কোনও শরণার্থী নয়, মিশরে কোনও শরণার্থী নয়। এই মানবিক সংকট গাজা এবং পশ্চিম তীরের ভেতরেই সামাল দিতে হবে এবং তাদের ভবিষ্যৎ অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া বা চেষ্টা করা যাবে না।’ এরসাথে সুর মিলিয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি কোনও শরণার্থী প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এটা হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য। ইসরাইলীদের পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের সবদেশ। জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে তারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। হামাস নিধনের নামে এযাবৎকালের নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে জনমানবহীন করে পুরো গাজা দখলে নেয়ার পর হয়তো পশ্চিমারা আবার ‘মানবাধিকার রক্ষার‘ (!) বুলি আওরাতে থাকবে। ফিলিস্তিনিরা কি এভাবে শুধু মার খেয়েই যাবে? ফিলিস্তিনের নিপীড়িত–নির্যাতিত আপামার জনতার প্রতি জানাই সহমর্মিতা ও সংহতি। এই মহান লড়াই–সংগ্রামে বিজয় অনিবার্য। প্রিয় বন্ধুরা, তোমাদের জন্যে রইল অফুরান শুভ কামনা।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।