আফ্রিকা মহাদেশে শ্বেতাঙ্গদের বর্বরতা দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সভ্যের বর্বর লোভ/নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা”। সভ্যের সেই বর্বরতা এখনো সমানে চলছে পৃথিবীতে। এ মুহূর্তে দু’টি স্থানীয় যুদ্ধের নামে বর্বরতা চলছে– গাজা ও ইউক্রেনে। “মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের” জন্য প্রাণপাত করা “গণতান্ত্রিক”? বিশ্ব এই দুই যুদ্ধে “আক্রমণকারীর?” তথা হামাস ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে “গণতন্ত্র ও মানবাধিকার” রক্ষায় যুদ্ধক্ষেত্রের হাজার হাজার মাইল দূরের “গণতন্ত্রের মুরুব্বি” যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্েব।
১৯১৮ সালে বৃটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফুর মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। সেই কুখ্যাত “বেলফুর ঘোষণার” প্রেক্ষাপটে ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে জোর করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইলকে আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে তোলা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল জ্বালানি তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে নিজস্ব বলয়ে ধরে রাখা। মিসর সহ পুরো আরব উপদ্বীপে– সৌদি আরব, বাহরাইন, ইরান, ইরাক, কুয়েত, আরব আমিরাত সর্বত্র তখন ইসলাম রক্ষার নামে চলছিল অনৈসলামিক বাদশাহী শাসন। নিজেদের স্বার্থে এ সব আরব রাষ্ট্রের বাদশারা নিশ্চুপ থাকে। ফলে নির্বিঘ্নে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিদের সহিংসভাবে উৎখাত করে গাজা–লেবানন ও পশ্চিম তীরে অনিশ্চিত উদ্বাস্তু জীবন যাপন করতে বাধ্য করে। এই নৃশংস প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুরো “গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব”। এদিকে ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশকে নিয়ে গড়ে উঠে ন্যাটো নামে যুদ্ধজোট। এই যুদ্ধ জোট পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিতে থাকে নবোত্থিত সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপসহ সোভিয়েত রাশিয়াকে। অবশেষে ১৯৫৫ সালে পশ্চিমের হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো গড়ে তোলে পাল্টা “ওয়ারশ” যুদ্ধ জোট। শুরু হয় পৃথিবীতে ঠাণ্ডা যুদ্ধ।
“গণতান্ত্রিক” পশ্চিমের সমর্থনে ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর সহ মিসর ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার আয়তনেরও দ্বিগুণ জায়গা দখল করে নেয়। দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে ইজরাইল যুক্তরাষ্ট্রের দেদার সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় ও সৌদি আরবসহ তেলসমৃদ্ধ বাদশাহী আরব দেশগুলোর নীরব সমর্থনে। সেই সমর্থন এখনো অব্যাহত রয়েছে। ১৯৬০ এর দশকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। গড়ে উঠে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে। ইহুদী দখলদারদের হাত থেকে মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার প্রবল প্রতিরোধ যুদ্ধের অবিচল সাহসী নেতা হিসাবে সেকুলার ডেমোক্র্যাট বলে পরিচিত আরাফাত সারা বিশ্বের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফিলিস্তিন জনগণের অবিসংবাদী নেতায় পরিণত হন। বিশ্ব জনমতের চাপে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল বাধ্য হয় আলোচনায় বসতে। ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য গাজা ও জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় স্বায়ত্তশাসিত প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষ, যা বিশ্বে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইয়াসির আরাফাত এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বর্তমানে মাহমুদ আব্বাস আরাফাতের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।
সেই আরাফাতকে যেমন সহ্য করেনি ইসরাইল ও আমেরিকা তেমনি তাঁকে পছন্দ করেনি সৌদি আরবসহ বাদশাহী আরব রাষ্ট্রগুলো। তাদের মদদেই ফিলিস্তিনিদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে ধর্মান্ধ উগ্র সন্ত্রাসের পথে নিয়ে বিপথে চালিত করতে ২০০৭ সালে গঠিত হয় হামাস। যার পেছনে ছিল আমেরিকা ও মার্কিন দালাল আরব দেশগুলো। হামাস প্রথম আঘাত করে পিএলওকে এবং পিএলও’র কাছ থেকে দখল করে নেয় গাজা। একটি সশস্ত্র জঙ্গি গ্রুপ ইসরাইলের কিছু ক্ষতি সাধন করতে পারে, কিন্তু আমেরিকা ও ইসরাইলের যৌথ শক্তির কাছে সামরিক পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী–শিশুর জীবন এদের কাছে তুচ্ছ। তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলো আন্তরিক হলে, চাইলে মার্কিন সমর্থন থাকলেও ইসরাইল সাহস করত না আজ গাজায় গণহত্যা চালাতে। আরাফাত চেয়েছিলেন ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিভক্ত আরব বিশ্বকে এক করে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালাতে। কিন্তু মার্কিন চাপে আরব দেশগুলো তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি। অথচ হামাস কাদের ইঙ্গিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সামরিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে কিছু ইহুদী হত্যা করে একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে ইসরাইলকে নৃশংস সহিংসতা চালাবার এবং গাজা দখলের সুযোগ করে দিল তা সময়ে বেরিয়ে আসবে। মনে রাখা দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় মনে করে থাকে ইসরাইলের উপর হামলা মানে আমেরিকার উপর হামলা। এটা কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না আরব বিশ্বের ঐক্য ছাড়া। দূরবর্তী দেশ ইরানের সাহায্যে আমেরিকা ও ইসরাইলের যৌথ সামরিক শক্তিকে, হামাস পরাজিত করতে পারবে। নজিরবিহীনভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে দুইটি রণতরী ও হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য ইসরাইলে পৌছে গেছে।
১৯৯০ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার বিপর্যয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে ন্যাটো যুদ্ধ জোটকে রাশিয়ার সীমান্তের দিকে সম্প্রসারণ করতে শুরু করে। হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ রুশ সীমান্ত জুড়ে অবস্থিত ইউক্রেন ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ন্যাটোতে যোগদানের প্রক্রিয়া শুরু করে। মিনস্ক চুক্তি বরখেলাপ করে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা দেখে রাশিয়া নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে সরাসরি ইউক্রেনে হামলা চালায়। রাশিয়ার সরাসরি ইউক্রেন আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা জারী করে ও জেলেনস্কি সরকারকে হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা প্রদান করে চলেছে। মূলত ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর প্রক্সি যুদ্ধ চলছে। মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। শুধু অর্থ আর অস্ত্রের জোরে দেশে দেশে আজ চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্মত্ত দাপাদাপি। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ যেখানেই যুদ্ধ, গণহত্যা, প্রকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছিল এবং এখনো রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র অনুন্নত দেশগুলোতে বঙ্গবন্ধু, আলেন্দে, সুকর্ণ’র মত জনপ্রিয় নেতাদের হটিয়ে সামরিক বা অনির্বাচিত সরকারকে দিয়ে মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে কিছু লুটেরা তৈরি করে, সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে পুরো দেশকে সাহায্যের নামে লুটেরা অর্থনীতির মাধ্যমে দুনীতিতে ডুবিয়ে দিয়ে, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করে দিয়ে, ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিয়ে, সামরিক শাসকদের সমর্থন করে এসব দেশকে কব্জা করতে থাকে। চালু করে সেসব দেশে পুজিবাদের নিকৃষ্টতম রূপ স্বজন তোষণ মূলক রাজনৈতিক অর্থনীতি। ’৭৫ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে চলতে চলতে আজ অসহনীয় দুর্নীতি ও দুঃশাসনে নিপতিত হয়েছে।
পূর্বোল্লিখিত কায়দায় বাংলাদেশের পর পর দু’জন জেনারেল ও তাদের দল রাজনীতিকে ধর্মান্ধদের হাতে তুলে দিয়েছে আর অর্থনীতিকে অবাধ লুটপাটের ধারায় পরিচালনা করেছে। ফলে সমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষে আর অর্থনীতিতে গজিয়েছে কিছু লুটেরা একচেটিয়া অতি ধনী পরিবার। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সৃষ্ট জবরদস্তির এই দীর্ঘ দুঃশাসনে নির্বাচন ক্রমে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। সেই ধারা অব্যাহত রেখে আওয়ামী লীগও গত ১৫ বছর ধরে গণতন্ত্রহীনতা ও তীব্র লুটপাটের শাসনকে তীব্রতর করেছে। এই পরিস্থিতিতে কি শাসকগোষ্ঠী নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে?
এ পর্যন্ত এদেশে কোন নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানুষের ভোটদান নিশ্চিত করেছিল কিন্তু অনেক আগে থেকেই গড়ে উঠা দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতি তো নৈতিকভাবে অবাধ নির্বাচনের বিপক্ষে। কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, কালো টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে পারেনি। সে অর্থে সে নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ বলা যায় না। এই দীর্ঘ অগণতান্ত্রিক সামরিক বা বেসামরিক শাসনাধীনে নির্বাচনের নামে প্রহসন, নির্বাচিত স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন নিয়ে একেবারে নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎ এবার আমেরিকার কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। তারা অসৎ ব্যবসায়ী টাকা পাচারকারী, সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের উগ্র ধর্মান্ধ প্রচারণা, সংখ্যালঘু নিপীড়ন এসব অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিকুল বিষয় চোখে দেখে না, শুধু অবাধ নির্বাচন চান যা এদেশে কোন কালেও হয়নি। এ মুহূর্তে চীনকে দমাতে বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ দরকার। নানাদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভূ–রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাবনা আছে আরাকানের ভিতর দিয়ে চীনের বঙ্গোপসাগরে যাবার করিডোর বন্ধে রোহিঙ্গা উগ্রবাদী সংগঠন ও প্রায় বিশলক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দিয়ে মিয়ানমারের ও বাংলাদেশের কিছু অংশ নিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবী তুলে সহিংসতার মাধ্যমে চীনকে আটকে দেয়া এবং তাতে ঢাকার সমর্থন অতি গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাপী অনুসৃত মার্কিন নীতি ও দস্যুবৃত্তির শিকার আজ ইউক্রেন, ফিলিস্তিন এবং বাংলাদেশের মানুষ যারা আগামীতে আরো প্রত্যক্ষভাবে এর কুফল ভোগ করবে। ক্ষমতা নিয়ে এই মারণ খেলায় অসহায় দুর্বল মানুষ আতঙ্কিত। কিন্তু মুর্খ শাসক গোষ্ঠী জানে না প্রকৃতির প্রতিশোধ হবে আরো ভয়ংকর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।