এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছিল, তার কিছু অংশ বাতিল ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের যে বিধান আওয়ামী লীগ করেছিল, তা বাতিল হয়ে গেল। তার জায়গায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরল।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে করা দুই রিট মামলার রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এ রায় দেয়। রায়ে আদালত বলেছে, বিগত তিন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। এর মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি–সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে। পাশাপাশি পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। ৭ (ক) অনুচ্ছেদে অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। ৭ (খ) সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল। খবর বিডিনিউজের।
সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ে বলা ছিল এবং ৪৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাই কোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটাইয়া সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তাহার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ঐ সকল বা উহার যে কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করিতে পারিবেন।
আদালত বলেছে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের কথা ছিল, যা পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল করা হয়। এ বিধান বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ বিবেচনায় তা বাতিল ঘোষণা করা হলো এবং দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
ঐতিহাসিক রায় : রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে যে সংশোধনী আনা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। তার অর্থ হলো সেই ব্যবস্থা পুর্বহাল হলো।
রিটকারীদের আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রায়ের ব্যাপারে আমরা খুব খুশি। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেটার অবসানের ক্ষেত্রে আজকে গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইলফলক অর্জন করলাম।
তিনি বলেন, যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র এগুলো বাংলাদেশ সংবিধানের মূল কাঠামো এবং যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্র এবং নির্বাচনকে সুসংহত করে, সেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও সংবিধানের একটা মূল কাঠামো। এ কারণে আজকে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র সাংবিধানিক নয়, সাংবিধানিক এবং সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ বলে রায় দিলেন। সেটা আমি মনে করি, একটা ঐতিহাসিক। তবে তিনি মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখনই ফিরে আসছে তা বলা যাবে না। কারণ ওই ব্যবস্থাকে দুইভাবে বাতিল করা হয়েছিল। প্রথমত, মাননীয় আপিল বিভাগ বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে একটা রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করে। কাজেই এটাকে দুইভাবে বাতিল করা হয়েছিল। আজকে পঞ্চদশ সংশোধনী যেহেতু বাতিল হলো, সংসদের মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়, সেই প্রতিবন্ধকতা আমরা পার হয়ে এলাম। কিন্তু আমাদেরকে এখনও বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে যে রায়, সেটার পুনর্বিবেচনা এবং সেটা পরিবর্তিত হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার জন্য।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সেই সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। জানুয়ারি তৃতীয় সপ্তাহে সেই শুনানি হবে জানিয়ে শরিফ ভূঁইয়া বলেন, ওই আবেদনের রায় যদি রিভিউ আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে। তিনি বলেন, আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা বাতিল চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি (হাই কোর্ট) অন্যান্যগুলো রেখে দিয়েছেন, সেখানে বলেছেন, সেগুলো উনি বৈধতাও দিচ্ছেন না। ভবিষ্যতে যে সংসদ আসবে তাদের জন্য রেখে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজনে সেগুলো রিভিউ করে রাখতে পারেন, চাইলে বাতিলও করতে পারেন। এর ফলে যে নির্বাচন হবে, সেটা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে। যেটা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি বাতিল করে এবং গণভোট পুনর্বহাল করে দেওয়া হাই কোর্টের রায় ঐতিহাসিক উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, হাই কোর্টের এমন রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হলো।
জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণরূপে বাতির ঘোষণা করা হয়নি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সমস্ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করা হয়েছিল, তার কিছু অংশ তিনি রেখে দিয়েছেন। কিছু জিনিস বাতিল করেছেন আর কিছু জিনিস পরবর্তী সংসদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক বৃত্তান্ত : ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারের অধীনে হয় সাধারণ নির্বাচন হলেও তখন বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে বিএনপি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। পরের বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট সেই রিট খারিজ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধই থাকে।
হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করেন রিটকারীরা। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় ৮ জন আইনজীবী বক্তব্য দেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।
ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবিএম খায়রুল হক। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিসহ ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি।
ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়; রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয় সংবিধানে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরানোর দাবি ফের জোরালো হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ১৮ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট ১৯ অগাস্ট রুল দেয়। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পরে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকজন ব্যক্তি এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়। তাদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন। ৩০ অক্টোবর শুনানির পর নভেম্বরে ৯ দিন এবং ১ ডিসেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর রুলের ওপর শুনানি হয়।
এদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত অক্টোবরে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২৯ অক্টোবর হাই কোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেয়। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরে সেই রুলের ওপর শুনানি হয়।
গতকাল রায়ের দিন রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল জব্বার ভুঁইয়া, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। রিটকারী বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান এ. সিদ্দিকী।