বিশ্ব চলচ্চিত্রে ‘গেরিলা সিনেমা’ বলে যে বিশেষ জঁর বা প্রকরণ রয়েছে তা মূলত লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ও আবর্তিত। পৃথিবীর সর্বদক্ষিণ কৌণিক এই মহাদেশটি ১৯৫০ অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত অর্থাৎ চার দশকের বেশি সময় ধরে অগ্নিগর্ভ হয়ে রয়েছিল। এই উপমহাদেশের ৩৪ টি দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সহায়তাপুষ্ট সামরিক জান্তারা বছরের পর বছর অকথ্য গণহত্যা চালিয়েছে, ন্যূনতম নাগরিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দিয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে, মানবতা চূড়ান্তরকমভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল পুরো মহাদেশটি জুড়ে।
এর প্রতিবাদে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছিল সবকটি দেশের চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ছাড়াও অন্যান্য শিল্পসেবী, যেমন নাট্যশিল্পী, কবি-সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী এমন কি বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল রাজনীতি কর্মীরাও চলচ্চিত্রের ছায়াতলে এলেন। সবাই বুঝলেন আর কোনো মাধ্যমে এত সহজে ও ভালোভাবে এসব অত্যাচার অনাচারের কথা তুলে ধরা যাবে না। স্বদেশে কাজ করেছেন এরা লুকিয়েচুরিয়ে, ছদ্মবেশে কিংবা বিদেশে আত্মগোপন করে ঝটিকা আক্রমণের মতো করে স্যুটিং করেছেন। তাই এঁদের আখ্যায়িত করা হলো ‘গেরিলা চলচ্চিত্র কর্মী’ এবং লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র হয়ে উঠলো ‘গেরিলা চলচ্চিত্র’।
সামরিক জান্তাদের হাতে এই মহাদেশের যত চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, প্রদর্শক, অভিনয় শিল্পী, কলাকুশলী অকাতরে অসংখ্যহারে গুম হত্যার শিকার পৃথিবীর আর কোথাও তা হয়নি। মিগুয়েল লিন্ডিন, ফার্নান্দো সোলানাজ, ফানার্দো বিরি, রবার রোচা, কার্লোস আলভারেজ, হুগো জারা মিলো, মারিও অরিয়েতা, হামবার্তো রিওস, অগ্রগণ্য কয়েকজন গেরিলা চলচ্চিত্রীর নাম যারা নানাভাবে গ্রেপ্তার, গুম, খুন, নির্বাসন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন-এঁদের মধ্যে ফার্নান্দো সোলানাজ ছিলেন আর্জেন্টিনার মুখ্য একজন পরিচালক, মূলত: রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবেই যিনি বিশ্বখ্যাত ছিলেন। আর্জেন্টিনা ও লাতিন আমেরিকার বিপর্যস্ত রাজনীতি ছিল যাঁর চলচ্চিত্রের প্রধান উপজীব্য।
সাহসী সেই চলচ্চিত্র সেনানী ফার্নান্দো ইজেকুয়েল পিনো সোলানাস প্রয়াত হলেন ৭ নভেম্বর (২০২০) এর সকালে। চলে গেলেন আরো একজন ফিল্ম মায়েস্ত্রো।
সোলানাসকে আর্জেন্টিনার প্রধান চলচ্চিত্রকার বলা হয় আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বিশ্বখ্যাত চিত্রপরিচালক তিনি। এদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে হামবার্তো রিওস, রাউল দ্য লা তোর, আলবার্তো ফিশারম্যান, জুয়ান জোশে স্তাগুয়েরো, গেরার্দো, ভ্যালোজা, ওক্তাভিয়ো গেতিনো অন্যতম।
সোলানাজ ১৯৬৯ সালে ওক্তাভিয়ো গেভিনোর সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করে তাঁদের মহৎ রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘দ্য আওয়ার্স অফ দি ফার্নেসেস। এই ছবিটি তাদের দুজনকে বিশেষ করে সোলানাজকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। সাড়ে চার ঘন্টার এই ছবিটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। তিনটি পর্বের তিনটি নাম (১) নতুন উপনিবেশবাদ ও হিংসা (২) মুক্তি সংগ্রামের জন্য করণীয় কাজ (৩) হিংসা ও মুক্তিসংগ্রাম। এই ছবি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের সেরা একটি নিদর্শন হয়ে রয়েছে। সোলানাজরা গুরু মানতেন সের্গেই আইজেনস্টাইনকে। ব্যাটলশীপ পটেমকিন ছিল তাদের পাঠ্য চলচ্চিত্র। এই ছবিটি পুরো লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র কর্মীদের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল। মহাদেশের সামরিক জান্তারাও ছবিটির পটভূমি ও শক্তি সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। তারা পুরো মহাদেশে ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। চিলির জান্তা পিনোচেত এই ছবির সব প্রিন্ট যোগাড় করে অগ্নিদগ্ধ করেন। কিন্তু সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা মহাদেশে।
‘দি আওয়ার্স অফ দি ফার্নেসেস’ লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র শিল্পকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। কেবল তাই নয়, ছবিটি ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা পৃথিবীকে উদ্বেলিত করেছিল। ফার্নান্দো সোলানাজকেও করে তোলে বিশ্ববরেণ্য। বিশ্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পত্রিকা কাঈয়ে দু সিনেমা তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে সে সময়। সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন অংশে সাহসী সোলানাজ বলেন, ‘ আমাদের ছবি আর্জেন্টিনার বাস্তব অবস্থা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রচেষ্টা সম্বন্ধে আমাদের চিন্তার স্বচ্ছতা অনুসন্ধানের এক চেষ্টা।’ ‘আইজেনস্টাইন ও ভের্তভের পেছনে ছিল সোভিয়েতের ক্ষমতা, আর আমাদের পেছনে ছিল পুলিশ।’ ‘আমরা লেলিনের মতোই বিশ্বাস করি, নির্যাতিত দেশগুলির জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধপন্থী নির্যাতনকারী দেশগুলির জাতীয়তাবাদের সমর্থক। কাঈয়ে দু’সিনেমা বলে, ‘ এই চলচ্চিত্র সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র।’
‘দি আওয়ার্স’ সোলানাসের সাহস, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁরা চলচ্চিত্রের যে ধারাকে ‘থার্ড সিনেমা’ বলে অভিহিত করতেন, সেই স্বাধীন ধারা যেটি নিউ বিয়ালিজমেরই সাহসী একটি অভিমুখ-সেই সাহসী চলচ্চিত্র আন্দোলন ও চর্চার একজন পুরোধা পুরুষ। ক্রমান্বয়ে তিনি এই ধারায় নির্মাণ করলেন বেশ কটি ছবি। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দি সন্্স অফ ফিয়েরো, ট্যাংগোস্ট, দি এঙাইল অফ গার্ডেল, দি সাউথ, দি জার্নি, ক্লাউডস, পেরন, দি জাস্টিশিয়েল রিভলিউশন। ছবিগুলি আর্জেন্টিনার সমাজ রাজনীতির বাস্তবতায় নির্মিত হলে সারা বিশ্বকেই প্রতিস্থাপিত করে। বিশেষ করে দি জার্নি। পিতাকে খুঁজতে গিয়ে পুত্র মার্টিনের এই ভ্রমণ হয়ে ওঠে আমাদের প্রত্যেকের জীবন পর্যটন। তেমনি অন্য ছবিগুলো কেবল আর্জেন্টিনার চিত্রবিশেষ হয়ে না থেকে বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। দি জার্নি নিয়ে ১৯৯৪ সালে তিনি কোলকাতায় চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছিলেন সস্ত্রীক। তখন তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। বুয়েনেস আয়ার্সের ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাটিক অটি থেকে অভিনয় ও নির্দেশনায় স্নাতক ফার্নান্দো সোলানাসের জন্ম ১৯৩৬ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি। রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন বরাবর। বহুবার আক্রান্ত হয়েছেন রাজনীতি করতে গিয়ে। আর্জেন্টিনার পার্লামেন্টে সিনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষদিকে বাধ্য হয়ে ফ্রান্সে বসবাস করতেন। ২০২০ সালে ৭ নভেম্বর প্রয়াত হলেন এই ফিল্ম মায়েস্ত্রো দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবসানে।