চীন বাংলাদেশের প্রায় ৯৭ভাগ রপ্তানি পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এটি পুরনো খবর। নতুন খবর হচ্ছে, এক শতাংশ পণ্যও এই সুবিধা নিয়ে চীনের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত বহু পণ্য চীনের বন্দরে আটকা পড়ে আছে। শুল্কমুক্ত সুবিধার কাগজ না পৌঁছানোর ফলে চীনা আমদানিকারকরা তা খালাস করছে না। অপরদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ‘চীনা বুদ্ধি’র কাছে মার খেয়ে তা নস্যাত হতে চলেছে। শুল্কমুক্ত সুবিধার জন্য অত্যাবশ্যক ‘চায়না ফরম’ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে চীন সুকৌশলে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। চায়না ফরমের সংকটে চীনে পণ্য রপ্তানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগি দেশ চীন। বহুবছর ধরে চীন বাংলাদেশে একচেটিয়া পণ্য রপ্তানি করে আসছে। চীনা পণ্যের বিরাট বাজার বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল থেকে শুরু করে রান্নার চুলা পর্যন্ত সবই আসে চীন থেকে। দেশের সর্বমোট আমদানি পণ্যের প্রায় ২০ শতাংশ আসে চীন থেকে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি করা প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের মধ্যে চীন থেকে এসেছে ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অপরদিকে চীন সারা পৃথিবী থেকে ২৪০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও বাংলাদেশ থেকে নিয়েছে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের সর্বমোট রপ্তানির ১ শতাংশেরও কম পণ্য যায় চীনে। বাংলাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানির যে তালিকা প্রস্তুত করেছে তাতে চীনের অবস্থান ১৫তম। অনেক বছর ধরে ভয়াবহ রকমের বাণিজ্য ঘাটতি চলে আসছে দুই দেশে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘাটতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
চীনের বিশাল আমদানি বাণিজ্যের শুধুমাত্র ১ শতাংশও যদি পাওয়া যেতো তাহলে অতিরিক্ত ২০ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পারতো বাংলাদেশ। এতে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে গত কয়েকবছর ধরে চীনের সাথে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশকে ব্রান্ডিং করার পাশাপাশি চীনের সাথে সম্পর্ক অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ঘনিষ্ট করা হয়েছে। সরকারের পূর্বমুখী নীতি এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এসব প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় চীন ২০২০ সালের জুলাই থেকে ট্যারিফ লাইনের আওতায় অন্তত ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু করে। চীনের এ উদ্যোগ দেশের তৈরি পোষাকখাতসহ ব্যবসায়ীদের মাঝে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানায়, দুই সংখ্যার এইচএস কোড বা চ্যাপ্টারের হিসেবে বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে ৯৮ ধরনের পণ্য চীনে রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই তৈরি পোষাক। এছাড়া পাট, পাটের সুতা ও টেক্সটাইল সুতা (এইচএস ৫৩), মাছ, কাকড়া-কুচিয়া, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, সবজি, চা, কফি, তৈলবীজ এবং অপ্রচলিত বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। পশুর নাড়িভুড়ি থেকে শুরু করে নানা পণ্যের বড় বাজার রয়েছে চীনে।
এতে রপ্তানি দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও ‘চীনা বুদ্ধি’র কাছে মার খাচ্ছে বাংলাদেশ।
শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকার কারণে চীনের বহু আমদানিকারকই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে উৎসাহী। কিন্তু সরকারি নীতির কারণে তারা পদে পদে সংকটে পড়ছে। পণ্য চালান রপ্তানি করার ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কাগজপত্রের সাথে ‘চায়না ফরম’ নামের একটি ফরম পূরণ করে দিতে হয় রপ্তানিকারকদের। এই চায়না ফরম ঠিকভাবে চীনে পৌঁছার পরই কেবল ওই দেশের আমদানিকারক শুল্কমুক্ত সুবিধায় চালানটি বন্দর থেকে খালাস করতে পারবেন।
চীনে রপ্তানি সংক্রান্ত সব ধরনের কাগজপত্র বাংলাদেশ বিজি প্রেসে ছাপাতে পারলেও ‘চায়না ফরম’ ছাপানোর অনুমোদন তারা দেয়নি। এ ‘চায়না ফরম’ চীনা দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোকে দেয়া হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সারাদেশের আঞ্চলিক অফিসগুলোতে এ ফরম প্রদান করে। যেখান থেকে ফরম নিয়ে রপ্তানিকারকরা পূরণ করে চীনের আমদানিকারকের নিকট পাঠিয়ে থাকেন। চীনের আমদানিকারকরা ওই ফরম জমা দিয়ে চালানটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাস করেন। পণ্য চালান পাঠানোর পরই কেবল এ ‘চায়না ফরম’ পাঠানো যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ফরমের ভয়াবহ সংকট চলছে। চীনা দূতাবাস থেকে দেশের চাহিদা অনুযায়ী ফরম সরবরাহ না করায় শত শত রপ্তানিকারক চীনে পণ্য পাঠাতে পারছেন না। আবার অনেকের পণ্যই ওইদেশে বন্দরে আটকা পড়ে আছে। শুল্কমুক্ত সুবিধার অভাবে আমদানিকারকরা তা খালাস করছেন না।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানয়- চট্টগ্রামে প্রতিমাসে অন্তত ৫শ’ ফরমের চাহিদা রয়েছে। অথচ ২০/৫০টির বেশি ফরম পাওয়া যায় না। এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র ও ফরম সরকার বিজি প্রেসে ছাপাতে পারলেও ‘চায়না ফরম’ ছাপানোর অনুমোদন দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ থেকে চীনে পণ্য রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করতেই কৌশলে ফরম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করা হয়। বিষয়টিকে ‘আমার দুয়ার তোমার জন্য চব্বিশ ঘন্টা খোলা তবে তোমাকে আসতে হবে ইন্ডিয়া ঘুরে’-এমন একটি ব্যাপার বলেও মন্তব্য করা হয়।
এ বিষয় গতকাল রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো চট্টগ্রামের পরিচালক শারমিন আক্তার বলেন, রপ্তানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা ফরম দিতে পারি না। ফরমের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই।
এ ব্যাপারে বিজিএমইএ’র প্রথম সহ সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। চায়না ফরমের জন্য আমাদের রপ্তানিকারকরা চরম সংকটে পড়েছেন। চীন আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও ‘চায়না ফরম’ এর সংকট সৃষ্টি করে পণ্য রপ্তানি ঠেকিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার কোন বিকল্প নেই মন্তব্য করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন- চীনের বিশাল বাজারে খুবই সামান্য একটি অংশ যদি আমরা ধরতে পারতাম, তাহলে আমাদের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেক
সহজ হতো।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চীন আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। অথচ একটি ‘ফরম’ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে দ্রুত আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিবেএমইএর পরিচালক মীর্জা আকবর আলী চৌধুরী বলেন, ফরমটি বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। এই ফরম পূরণ না করে কোন চালান চীনে পাঠানো হলে তাতে পণ্য রপ্তানি হবে, কিন্তু চীনা আমদানিকারক শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন না। তাঁকে শুল্ক দিয়েই চালানটি খালাস করতে হবে। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ‘ফরম’ আমরা চাহিদা অনুযায়ী পাই না। রপ্তানিকারকদের পাঠাতে পারি না। তারা শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ না পাওয়ায় দিনে দিনে আমাদের পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটি আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য একটি বড় সংকট। তিনি দ্রুত বিষয়টি নিয়ে কাজ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।