ফটিকছড়িতে ভয়াবহ বন্যায় মাছের প্রজেক্ট, ক্ষেতের ফসল, গৃহপালিত প্রাণী, রাস্তা–ঘাট ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০৯ কোটি টাকা। উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, বসতঘর সম্পূর্ণ ধসে পড়ে ৬০০টি এবং আংশিক ধস হয় ৪৮০০টির। যার ক্ষয়ক্ষতি ৯৬ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ক্ষতি ১২০ কোটি, মৎস্য খাতে ক্ষতি ৩৮ কোটি টাকা। স্থানীয় প্রকৌশল অফিসের হিসাবে রাস্তা, ব্রিজ–কালভার্ট ভেঙে ক্ষতি হয় ২২৩ কোটি টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে ক্ষতি হয় ১৫ কোটি টাকা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে টিউবওয়েল ও ল্যাট্রিন ভেঙে ক্ষতি হয় ১৪ কোটি টাকা। বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজে ৮৮ লাখ টাকা, হাস–মুরগি ও প্রাণি খাদ্য ১ কোটি ৬৩ লাখ, বিদ্যুৎ বিভাগে ৮ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাস্তা–ঘাট, ব্রিজ–কালভার্টের। টাকার অংকে ২২৩ কোটি টাকা। ক্ষতির পরিমাণে দ্বিতীয় কৃষি। উপজেলায় জমি প্লাবিত হয়েছে ২০ হাজার ৬১১ হেক্টর। ৩০ হাজার ৪৬৪ জন কৃষকের শাক–সবজি, ধানসহ ১২০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার জানিয়েছেন, ফটিকছড়ি পৌরসভা এবং ইউনিয়ন মিলে ২০টিতে টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি ছিল ৩৯ হাজার ৫৭৮টি পরিবার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক লাখ ৬৫ হাজার ৯৫০ জন। ফটিকছড়িতে বন্যায় ৫ জনের মৃত্যু হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ১৫০ টন চাল ৯ লাখ ৭৫ হাজার নগদ টাকাসহ অন্যান্য ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এখনও সরকারি সহায়তার পাশাপাশি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। তবে ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে যেসব ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে সেগুলো বণ্টনে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হচ্ছে।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সমপ্রতি অতিবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট আকস্মিক ভয়াবহ বন্যায় ফটিকছড়ি উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি, রাস্তা–ঘাট, মাছের প্রজেক্ট, ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ ৫০৯ কোটি টাকার সমপরিমাণ। আমরা বিষয়টি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবো।
হালদার ভাঙনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক গ্রাম : ফটিকছড়িতে সমপ্রতি ভয়াবহ বন্যার পানি শুকিয়ে গেছে। পানি কমার পরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। এখনো আতঙ্ক উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে হালদা পাড়ের বাসিন্দাদের। বর্তমানে সুয়াবিল ইউপির পূর্ব সিকদার পাড়ায় হালদার ৫ স্থানে বাঁধের ভাঙনে এলাকাটি দ্বীপে রূপান্তর হয়ে উঠেছে। এলাকাটি সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকার সাথে। চলছে না কোনো গাড়ি। অরক্ষিত জীবন যাপন করছে সুয়াবিল ২নং ওয়ার্ডের পূর্ব সুয়াবিল গ্রামের সিকদার পাড়ার ৩০০/৩৫০টি পরিবার।
শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিকদার পাড়ার চতুর্পাশ হয়ে বয়ে গেছে হালদা নদী। সমপ্রতি বন্যায় এই এক এলাকার ৫টি স্থানে ভেঙেছে মাটি দিয়ে দেওয়া হালদার নদী প্রতীরক্ষা বাঁধ। বাঁধের উপরেই ওই এলাকার প্রধান যাতায়াতের সড়ক। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ৫ পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এখন কোনো যানবাহন চলছে না। ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে কোনোভাবে যাতায়াত করছেন বাসিন্দারা। কিন্তু বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের স্কুল কলেজে যাওয়া। রোগী নিয়েও ভোগান্তিতে রয়েছেন স্বজনরা। অন্যদিকে প্রায় ৩০–৬০ফুট করে ৫টি ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় অরক্ষিত অবস্থায় দিন কাটছে এ এলাকার বাসিন্দাদের। যেকোনো সময় নদীতে পানি বাড়লে আবারো লোকালয়ে পানি ডুকে বিলীন হতে পারে ঘরবাড়ি।
ওই এলাকার বাসিন্দা নুরুল আলম নামের এক শিক্ষক বলেন, আমাদের এলাকার ৩০০মিটারের মধ্যে ৫টি স্থানে নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যায়। পানিতে আমরা আটকা পড়েছি। বিভিন্ন সংগঠন যদি নৌকা দিয়ে আমাদের উদ্ধার না করতো এখানে অনেকেই মারা যেত। এখন বন্যার পর হালদার ভিতরে ৫০০মিটার জায়গাজুড়ে যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে সিসি ব্লক না বসালে বাড়িঘর ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। ব্লক ছাড়া বাঁধ দিলে এ ভাঙন রক্ষা হবে না। বর্তমানে একটু বৃষ্টি হলেও পানি এসে এ এলাকা প্লাবিত হবে। এলাকায় ব্লক না বসালে এখানে আর বসবাস করা যাবে না।
ওই এলাকার একটি মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা ওসমান বলেন, বন্যায় আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এলাকার ৫টি ঘর পুরোপুরি পানি নিয়ে গেছে। হালদার ভাঙনে এখন যাতায়াত পথ সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। কোনো ধরনের গাড়ি নিয়ে কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না। কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাঁটিয়ে বা কাঁধে করে নিতে হবে। ব্লক দিয়ে বাঁধ না করলে ধীরে ধীরে এ এলাকা বিলীন হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহাগ তালুকদার বলেন, যে স্থানে বাঁধ ভেঙেছে তা মেরামতের জন্য তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়া চলছে। নদী পাড়ের মাটি ভেজা থাকলে বাঁধ টেকসই হবে না তাই শুকানোর পর কাজ শুরু করতে হবে। যেখানে যেমন ছিল সেখানে আগের মত বাঁধ করে দেয়া হবে। কিছু কিছু স্থানে জিও ব্যাগ বসাতে হলে তাই করা হবে।