প্ল্যান ছাড়াই নগরীতে কয়েক হাজার ভবন

কোনো সংস্থার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা বা জরিপ নেই নগর পরিকল্পনাবিদদের উদ্বেগ ভবনগুলো চিহ্নিত এবং অপসারণ করা জরুরি

হাসান আকবর | রবিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্ল্যান ছাড়াই নগরীতে আছে কয়েক হাজার ভবন। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নগরে প্রতি বছরই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বাড়ছে। যথাযথ উদ্যোগ এবং পরিকল্পনার অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো হুমকি হয়ে উঠছে। সিডিএর প্ল্যান নেই এমন ভবনগুলোতে বসবাস করছে মানুষ। চলছে ব্যবসাবাণিজ্য। আশেপাশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সময় এসব ভবন নড়ে ওঠে। মধ্যম মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলেও নগরীতে ‘ম্যাসাকার’ ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

জানা যায়, নগরে ভবন নির্মাণে সিডিএ শুধুমাত্র প্ল্যান প্রদান করে। বিদ্যুৎ, ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিস মিলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাও জড়িত থাকে প্রতিটি ভবনের সাথে। কিন্তু নগরীতে কোনো সংস্থার কাছেই বিস্তারিত জরিপ নেই। নেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা। সিডিএ থেকে অনুমোদন না নিয়ে নগরীতে একটি ইট স্থাপনেরও আইনি সুযোগ নেই। অথচ এই নগরে কয়েক হাজার ভবন রয়েছে যেগুলোর সিডিএর কোনো প্ল্যান নেই। একশ বছরের বেশি আগে নির্মিত অননুমোদিত ভবনেও মানুষ বসবাস করছে। পঞ্চাশ বছর আগেকার নির্মিত অনেক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সিডিএর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, নগরীতে প্রতি বছর গড়ে ১ হাজারের বেশি প্ল্যান প্রদান করে সিডিএ। কিন্তু সিডিএর দেওয়া প্ল্যানের বাইরেও নগরীতে কয়েক হাজার ভবন রয়েছে। কয়েক বছর আগে নগরীতে প্রায় ৫ হাজার ভবনের প্ল্যান না থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিল সিডিএ। প্ল্যান বহির্ভূত এসব ভবনের নির্মাণকাজ যথাযথভাবে না হওয়ায় প্রতিটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ফায়ার সার্ভিসের একটি তদন্তকারী দল সারা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ওপর জরিপ করেছিল। ওই জরিপে ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বেশি চিহ্নিত করা হয়েছিল। ওই জরিপে ঢাকা মহানগরীর ১০৪টি ভবনকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দল চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে উল্লেখ করেছিল, বন্দর নগরীতে ৩৯৮টি ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বাইরে ৫২৬টি বহুতল ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করা হয়।

নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, দিন যত যাচ্ছে নগরীতে ততই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বাড়ছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্ল্যান ছাড়া নির্মিত অনেক ভবনের ইটবালি খসে পড়ছে। ভিতরে সরু রড বের হয়ে হুমকি হয়ে উঠছে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার ব্যাপারে নানাভাবে উদ্যোগ নিয়েও পরে মামলার কারণে অগ্রসর হতে পারেনি।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ভবন কিছুটা কাৎ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। খাল খননের সময়ও কাত হয়েছে দীর্ঘদিনের পুরনো ভবন। পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ করার সময় খসে পড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পলেস্তারা ও ইটবালি।

কয়েকদিন আগে বাওয়া স্কলের পাশের ভবনটির বেশ কিছু আস্তর খসে পড়ার কথা উল্লেখ করে কয়েকজন অভিভাবক সিডিএর চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত পত্রে জানিয়েছেন, স্কুলের পাশে দেড় গন্ডার জায়গায় একটি পাঁচতলা ভবন রয়েছে। অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে নির্মিত ভবনটির নিচে দোকানপাট থাকলেও উপরের দিকে প্রায় পরিত্যক্ত। পাশের জায়গায় পাইলিং এবং বহুতল ভবন নির্মাণের সময় স্কুলের পাশের ভবনটি থেকে প্রায়শ পলেস্তারা খসে পড়ে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সামনের দিক থেকে ভবনটিকে কিছুটা ভালো মনে হলেও ভিতরে ও পেছনের দিকের অবস্থা ভয়াবহ। দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে, গাছ উঠেছে। বিষয়টি সিডিএ এবং ভবন মালিককে জানালেও প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ভবনটির কোনো প্ল্যান নেই উল্লেখ করে তারা বলেন, বাওয়া স্কুলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ, ব্যস্ততম এবং স্পর্শকাতর স্থানে এমন একটি অননুমোদিত ভবন শিশুদের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।

সিডিএর অথরাইরেশন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা ভবনটির প্ল্যান নেই বলে স্বীকার করে জানান, এটি অনেক পুরনো ভবন। ৮০ সালের দিকে কোনো ধরনের প্ল্যান না নিয়ে দেড় গন্ডারও কম জায়গায় প্রথমে একতলা, পরবর্তীতে জায়গার দাম বাড়ায় পাঁচতলা বানানো হয়েছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে স্বীকার করে সিডিএর কর্মকর্তারা জানান, ভবন মালিককে নোটিশ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

ভবনের মালিকপক্ষের একজন রাশেদ ইমাম ভবনের পলেস্তারা খসে পড়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ভবনটি অনেক আগে আমার বাবার কেনা। একতলা ভবনসহ তিনি জায়গাটি কিনেছিলেন। পরে উপরের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে। উনি মারা গেছেন। ওই সময় প্ল্যান নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সম্ভবত ছিল না। আমাদের ভবনটির কোনো প্ল্যান নেই।

সূত্র জানায়, নগরীতে অন্তত আড়াই লাখ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা অনেক। শুধুমাত্র পাশের অবকাঠামোগত নির্মাণের সময় নগরীতে গত এক বছরে অন্তত ১০টি ভবনের হেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দ্রুত ভেঙে ফেলা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নগরে এই ধরনের অন্তত ৫ হাজার ভবন কোনো না কোনোভাবে হুমকি হয়ে উঠেছে। এসব ভবনের ব্যাপারে সিডিএ এবং সিটি কর্পোরেশনকে যৌথভাবে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে বলে নগর পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন। তারা বলেন, মাঝারি আকৃতির ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রাম মহানগরীতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার বলেন, নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কোনো ডাটা কারো কাছে নেই। জরিপ করা হবে বলা হলেও হচ্ছে না। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করার হার শূন্যের কোটায়। একটি ভবনের প্ল্যান নেওয়ার পর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন অনুযায়ী হচ্ছে কিনা সেটি একজন কোয়ালিফাইড ইঞ্জিনিয়ারের দেখভাল করার কথা। উনি সার্টিফিকেট দেওয়ার পর সিডিএর অকোপেনসি সার্টিফিকেট ইস্যু করার কথা। অর্থাৎ ভবনটিতে বসবাস করা যায়। এসব কি অনুসরণ হচ্ছে? আমাদেরকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য আইন করা হলেও তদারকির অভাবে আমরা ঝুঁকি থেকে বের হতে পারছি না। প্ল্যান নিচ্ছে এমন ভবনের ক্ষেত্রে এই অবস্থা। আর প্ল্যান নেই এমন ভবনগুলোর ব্যাপারে কী বলার আছে?

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, নগরীতে অসংখ্য ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এটির সুরাহা হওয়া দরকার। সবাইকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত এবং অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এই কাজটি যত দ্রুত করা যাবে ততই নগরবাসী নিরাপদ হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিডিএ এবং সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকলেও ঝুঁকিপুর্ণ ভবন নিয়ে আপোষ করা উচিত হচ্ছে না। নগরজুড়ে জরিপ চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত এবং দ্রুত অপসারণ করা দরকার। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ঝুঁকিপুর্ণ ভবন চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, শুধু প্ল্যান নয়, ইউলিটি সার্ভিসের ব্যাপারগুলোও ঝুঁকির কারণ হয়ে ওঠে। এসবও দেখা দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডেঙ্গুতে শিশু ও নারীর মৃত্যু চট্টগ্রামে আক্রান্ত আরও ১২৪
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় যানজটে অচল মহাসড়ক