যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি শুধু নয়, মরণব্যাধির মতো আমাদের সমাজে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। যৌতুক যে দেয় এবং যৌতুক যে নেয় দু’জনেই সমান অপরাধী-এই আইনের মূল মন্ত্র জানলেও ক’জন তা মানে! এ ব্যাপারে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর আরও নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওগুলো যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে। গণমাধ্যমে যৌতুক বিরোধী প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
দৈনিক আজাদীর ২১ মার্চ সংখ্যায় ‘যৌতুকের জন্য যা করলেন যুবক’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে যে, প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ে করার পর প্রতারণামূলক নিকাহ নিবন্ধন না করে আরেক মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পটিয়া থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত যুবকের নাম খোরশেদ আলম (৩১)। তিনি চন্দনাইশ উপজেলাধীন দোহাজারী হাছানদন্ডী মাঝের পাড়া এলাকার আবুল কাশেমের পুত্র। রাশেদা বেগম নামের এক যুবতীর দায়ের করা মামলায় পটিয়া থানা পুলিশ খোরশেদকে গত শুক্রবার রাতে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। সংবাদে বলা হয়েছে, ৩১ জানুয়ারি খোরশেদ রাশেদাকে চন্দনাইশ কাঞ্চননগর মোস্তান আলী মসজিদে নিয়ে ইমাম সাহেবের মাধ্যমে বিয়ের আকদ পড়ান। এতে ১০ লাখ টাকা মোহরানা ধার্য করা হয়। বিয়ের পর থেকে খোরশেদ রাশেদার বাপের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তাকে বিয়ের কাবিন (নিকাহ্্ নিবন্ধন) করে রাশেদাকে ঘরে তুলতে বললে তিনি ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে বসেন। এই টাকা না দিলে অন্য আরেক মেয়েকে বিয়ে করার হুমকি দেন। টাকা না পেয়ে খোরশেদ আনোয়ারা উপজেলাধীন পীরখাইন এলাকার আরেক মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোন না কোন সময়, কোন না কোন ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। পারিবারিক সহিংসতার অনেকগুলো কারণের মধ্যে যৌতুক একটি অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু দরিদ্র পরিবারে নয়; সচ্ছল ও তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ পরিবারগুলোতেও যৌতুকের লেনদেনের ঘটনা ঘটছে ও যৌতুক না পেলে শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন করার ঘটনা ঘটছে। যৌতুক নেয়া বা দেয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও- একে তো বন্ধ করা যায়ইনি- বরঞ্চ দিনকে দিন এ যেন বেড়েই চলেছে। বিয়েকে উপলক্ষ্য করে অনেক বরপক্ষ কনেপক্ষের সঙ্গে চাঁদাবাজি করে- এর অপর নামই হল ‘যৌতুক নেয়া’! অনেক মেয়েই তাঁর যৌতুকের টাকা জমানোর জন্য দিন-রাত খেয়ে-না খেয়ে গার্মেন্টসে কিংবা গৃহকর্মীর কিংবা অনেক ধরনের কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন এবং বিয়ের পর এঁদের অনেকেই সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হন। যৌতুক অধিকাংশ ক্ষেত্রে বারবার চাওয়া হয় ও না পেলে বারবার নারীটিকে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে অনেক নারীই আহত বা নিহত হন।
জানা যায়, যৌতুক বন্ধে ১৯৮০ সালে ন’টি ধারা নিয়ে হয় যৌতুক নিরোধ আইন। তাতে কাজ না হওয়ায় ১৯৯৫ সালে হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান আইন। এ আইনে কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হলো। শেষ পর্যন্ত এটাও ব্যর্থ হলো। সর্বশেষ ২০০০ সালে হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। এরপর হলো ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৭’।এর আওতায় কোনো নারীর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষের অন্য যেকোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা (প্ররোচিত করে) করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মারাত্মক জখমের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা ন্যূনতম ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। কিন্তু শুধু আইন করে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব বলে মনে হয় না। এজন্য প্রয়োজন ঘর থেকে ঘরে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া। সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখতে কেবল নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও উপহারের নামে যৌতুক দেয়ার যে চল রয়েছে বাংলাদেশে, তা ভেঙে দিতে হবে। সমাজকে যৌতুকমুক্ত করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা।