প্রদীপের আলো যেমন করে অন্ধকারের স্থবিরতাকে সরিয়ে দিয়ে কল্যাণের দ্যুতি ছড়ায় জগৎময়,ঠিক তেমনি করেই সমগ্র দেশের সমাজব্যাবস্থা,শিক্ষা ও সাহিত্যে এক নবজাগরণের দ্যুতি ছড়িয়েছেন ‘শিক্ষা ও সাহিত্য: পাদপ্রদীপের আলোয় গ্রন্থে বর্ণিত আলোর পথিকেরা।
এ গ্রন্থে লেখিকা বদরুননেসা সাজু সমাজসেবা, দেশপ্রেম,মানবতা,শিক্ষা ও সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ ব্যাক্তিবর্গের জীবনের কর্মপ্রবাহ তথা আলোর পথিক হয়ে উঠার গল্প শুনিয়েছেন অতি যত্নে এবং ঝরঝরে ভাষায়। সাধারণত প্রবন্ধ শব্দটা শুনলেই মনের কোণে ভেসে উঠে বেশ ভাবগম্ভীর বিষয় নিয়ে কঠিন শব্দে ভরপুর একটি গ্রন্থ কিন্তু এই বই আমার সেই ধারণাকে ভেঙে দিল নিমেষেই। এই প্রবন্ধ পড়ে জানলাম একের পর এক আলোর দিশারীর গল্প। প্রিয় পাঠক এই গ্রন্থ পাঠ করে আপনি নিজেও আলোকিত হবেন।পড়ে দেখুন,তাহলে বুঝবেন আপনার নিজের জীবনকে আলোর পথে উজ্জ্বল করে গড়ে তোলার কীরূপ প্রেরণা লাভ করছেন,এই বই থেকে।
এখানে যাদের সম্পর্কে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে তারা হলেন- মাদার তেরেসা (সেই মহীয়সী যিনি তাঁর প্রার্থনায় অনাথ শিশুদের মা হতে চাইতেন), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (মাজারের খাদেম, মসজিদের ইমাম, রেল গার্ডের চাকরি, রুটির দোকানে চাকরি থেকে শুরু করে ১৯২৪ সালে বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করার এক বিস্ময়কর গল্প উঠে এসেছে এই প্রবন্ধে),স্বামী বিবেকানন্দ: সিস্টার ক্রিস্টিন,শিক্ষয়িত্রী নিবেদিতা, দৈনিক আজাদীর অন্তহীন ভাবনার লেখক মোফাচ্ছেল আহমদ চৌধুরী, বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, প্রফেসর ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদ। তাঁদের কর্মতৎপরতা, ক্ষুরধার লেখনী, অনূদিত কবিতাসহ তাদের জীবন বৈচিত্র্যের আস্বাদ গ্রহণ করতেও মননশীল পাঠকের জন্য এ-বইটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য হবে।
শিক্ষা ও সাহিত্য : পাদপ্রদীপের আলোয় প্রবন্ধটিতে গ্রন্থিত সফল সংগ্রামী নারী লেখকদের মধ্যে আছেন চট্টগ্রামবাসীর একান্ত সুপরিচিত প্রিয় ব্যক্তিত্ব, জাগরণের প্রতীক- রম্য সাহিত্যিক ফাহমিদা আমিন, জীবন সংগ্রামী সাহিত্যিক মমতাজ সবুর, মরমী সাহিত্যিক বেগম রুনু সিদ্দিকী, অধ্যাপিকা সালমা চৌধুরী, অধ্যক্ষ নিলুফার জহুর এবং বাস্তবতার বিস্ময়, একাত্তরের জননী, সাহিত্যিক রমা চৌধুরী। কর্মদক্ষতা,মানবপ্রেম,সমাজসেবা ও গতিময় লেখালেখির উজ্জ্বলতায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এরা শিক্ষা ও সাহিত্যকে অসামান্য অবদানে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘গুণী ব্যাক্তিদের প্রতি সম্মান জানালে সমাজে আরো গুণীজন গড়ে উঠবে’- এই চেতনাই লেখককে প্রবন্ধটি লিখতে উদ্বীপিত করেছে এবং সেদিক থেকে বলা যায়, স্বল্প পরিসরে অনেক গুণীজন সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য একটি সহজ মাধ্যম হতে পারে এই বই।
এই বইয়ে কিছু বহুমাত্রিক বিষয়ও সংযোজন করা হয়েছে। বিধৃত হয়েছে পদে পদে বাধাগ্রস্থ হওয়া সহজ সরল নারী জীবন। নতুন পরিবেশে স্বামীসহ,নিকটাত্মীয়, দূর-আত্নীয় সমভিব্যহারে একটি মেয়ের বধূ হয়ে উঠার গল্প ভেসে উঠেছে এই প্রবন্ধে। সেখানে মেনে নেওয়া, মানিয়ে চলা তথা খাপ খাওয়ানোর আবহে বিচিত্র পরিবেশ ও বিষয়বস্তুর তথ্য উপাত্তের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে কয়েকটি নিবন্ধে। মা-দাদীরা বিভিন্ন সদুপদেশে বুঝিয়ে তাদের আদরের কন্যাটিকে পরের ঘরে পাঠানোর উপযুক্ত করে তোলেন -ধৈর্য ধর, সহ্য কর, মাটির দিকে দেখো- পা দিয়ে মাটিকে কয়েক ঘা মারলেও মাটি নির্বাক। পুকুরের দিকে তাকাও- ঢিল ছুড়লেও সামান্য মাত্র আলোড়িত হয়। এই উদাহরণগুলো ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। এই দৃশ্যপটগুলো ফুটে উঠেছে যে লেখাগুলোতে সেগুলোর শিরোনাম হল- নারী: দূর-ব-হু-দূ-র তোমার ঠিকানা, নারী শিক্ষা……, নারী – বিয়ে ও লেখালেখি, গৃহী – নারীর কর্মপ্রয়াসে গৃহসুখ, জনসংখ্যা বৃদ্ধিরোধে নারী শিক্ষা, শিক্ষিত নারী ও পরিবার যেখানে প্রসংগ এসেছে নারী শিক্ষার প্রসার এবং নারী জাগরণ সম্পর্কে।
বইয়ের শেষের দিকে যে নিবন্ধ – প্রবন্ধ রয়েছে সেগুলোর শিরোনাম হচ্ছে: হিংসা বিদ্ধেষ মুছে সমপ্রীতিরর উদার পরিবেশে এবং শিক্ষার আলোয় স্নাত।মানুষের সুন্দর জীবন গঠনে এ দুটো প্রবন্ধের শিক্ষা একান্ত কাযকরী ভূমিকা পালন করবে।শিক্ষার আলোয় স্নাত হতে হলে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই লেখক এখানে জীবনের সফলতায় প্রকৃত শিক্ষকের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। তাঁর শিক্ষাজীবনের স্মৃতিময় কিছু মানুষকে হারানোর বিষাদও এখানে প্রকাশ পেয়েছে। যারা ছিল চোখের সামনে কর্মব্যস্ত,তাদের আকস্মিক জীবনাবসান আমাদের ব্যাথা ভারাক্রান্ত করেছে,ভাবিয়ে তুলেছে।তাই সর্বশেষ লেখার শেষের দিকে এরূপ চিরবিদায়ের প্রতিফলন ঘটেছে।
প্রাবন্ধিক বদরুননেছা সাজু’র জন্যে শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা। ‘শিক্ষা ও সাহিত্য:পাদপ্রদীপের আলোয়’ বইটিতে লেখিকা তার ব্যক্তি মানস সরোবর থেকে তুলে আনা এক একটি পদ্মকে শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে অর্পণ করেছেন বইতে সংযোজিত আলোকিত ব্যাক্তিবর্গকে। বইটি একুশে বইমেলা ২০২০ উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে শৈলী প্রকাশন থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন উত্তম সেন। এ পর্যন্ত তাঁর বেশ কয়টি বই পাঠকের ভালোবাসা জয় করতে সমর্থ হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘শব্দহীন রাতের শব্দ’, ‘চিরন্তন পথিকৃৎ’,‘নিসর্গ আলোর ঠিকানা’ নারী জাগে কর্মযজ্ঞে আনন্দে’ এবং সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ‘জেগে উঠার দিন’।