কৈশোর পেরিয়েই নগর প্রবেশ। গ্রামের আলো-হাওয়া কাদামাটির সোঁদা গন্ধ গায়ে জড়িয়ে। আগে বাবার হাত ধরে রেলে চেপে এসেছি বহুবার। স্মৃতিগুলো ঝাপসা এখন। প্রথম রেলে চড়ার স্মৃতি অবিস্মরণীয়! সম্ভবত বিনা টিকিটে ভ্রমণ। হাফ টিকিট কেনার বয়সও হয়নি, তাই। কাটিরহাট রেল ষ্টেশনের ওয়েটিং রুমে বাবার হাত চেপে রাখি ভীষণ উত্তেজনায়। মনে হচ্ছিল, আমি স্বর্গে যাচ্ছি! এত আনন্দ শিহরণ। লম্বা ও তীক্ষ্ণ হুইশেল বাজিয়ে ট্রেন ষ্টেশনে ঢোকে ধীরে। ঝিক ঝিক ধাতব শব্দ এখনো বুকে গাঁথা। কয়লাখেকো ইঞ্জিন। হঠাৎ থামে, থেমে যায় হার্টবিটও! তারপর স্বর্গযানে আরোহন। জানালার পাশে বসে ট্রেন নয়, উড়ে যাচ্ছে পাশের বাড়িঘর, খালবিল, টেলিগ্রাফের খুঁটি। মনে হচ্ছে, ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আর সবুজ লোকালয়, মাঠ, ঘাট দৌড়াচ্ছে তীব্র গতিতে। আজ থাক, অন্য কোন কিস্তিতে হবে।
এরপর কখন যে, নগরটা নিজের একান্ত আপন হয়ে গেল জানিনা। দেশের ভেতর বা বাইরে যেখানেই যাই, খচখচায় মন। বিশৃঙ্খল জনারণ্য, বিদেশী নগরের তুলনায় একেবারেই অগোছালো নগরটির জন্য। নাড়ির সাথে বিনিসূতোয় বাঁধা পড়ে আছে প্রিয় নগর। আসলে এটাতো নিছক কোন বড় নগর না, দেশের সবচে’ দামি সম্পদও। চট্টগ্রাম বন্দর মানে অর্থনীতির প্রাণভোমরা। দেশের আমদানি রপ্তানির হৃদপিন্ড। অর্থনীতির উঠানামা, গতি, প্রবৃদ্ধি সব চট্টগ্রামকে ঘিরেই। উন্নয়নেরও কমতি নেই। কর্ণফুলী তলদেশে তৈরি হচ্ছে, চিনা সহযোগিতায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রথম টিউব টানেল। ২০২২/২৩ সালে টানেল ওয়েটি চালু হলে চট্টগ্রাম নগর হবে দেশের সেরা উন্নয়ন ‘হাব’। পাশাপাশি একটু যত্নআত্তি নিলে নগর ঘিরে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলও দেশের পর্যটন শিল্পে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা যোগান দেবে জাতীয় রাজস্ব ভান্ডারে। আর সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনার বিশাল খনিতো আছেই।
দুঃখজনক হলে সত্য, আমাদের মহানগরটা পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে ওঠেনি। সিডিএ’র সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যানের ফাইলও পোকায় কাটছে। এখনো এলোমেলোভাবে বাড়ছে জনবসতি। সড়ক কাঠামোও একদম নাজুক। জমির দাম যত বাড়ে, লোভের হা’ও তত বাড়ে। পানি প্রবাহের অসংখ্য খাল, ছড়া ছিল নগরের ধমনী প্রবাহ। চাক্তাই খালসহ এই ধমনীগুলো এখন রাক্ষসের পেটে। স্বাভাবিক কারণে সামান্য বৃষ্টি বা জোয়ার জলে অর্ধেক নগর তলিয়ে যায় পানির নিচে। শুধু চাক্তাই খাল বা ছোট বড় খাল ছড়া নয়, চট্টগ্রামের মূল নদী কর্ণফুলী, হালদাও জবর দখলে! উদ্ধার অভিযান আটকে যায়, বড় দখলদারের মামলার জালে। ওয়াসা আছে নামে, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নাধীন থাকলেও স্যূয়ারেজ ব্যবস্থাপনার কাজ শুরু হয়েছে, মাত্র বছর আগে। অগ্রগতি কী, দেখভালে সমন্বিত কর্তৃপক্ষ নেই। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে জলাবদ্ধতা নির্মূল, স্যূয়ারেজ ব্যবস্থা চালু, সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহে হাজার হাজার কোটি টাকার মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। পথটা যে কবে শেষ হবে, জানেনা কোন কর্তৃপক্ষ।
মূল সমস্যা হচ্ছে, সমন্বিত শক্তিশালী তদারকি কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, টেলিকম, বন্দর, রেল, গ্যাস পরিচালন সংস্থার মত বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের মত করে কাজ করছে। পরিকল্পিত সমন্বয় না থাকায় এক সংস্থার উন্নয়ন কাজে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্য সংস্থা এবং সড়ক, জনপদ। এতে উন্নয়নে দীর্ঘসূত্রতাসহ অহেতুক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রকল্প খরচও।
এদিকে দেশের উন্নয়ন প্রবাহে সরাসরি লাভবান গ্রামের স্বচ্ছল মানুষ স্রোতের তোড়ে ভীড় করছেন নগরে। অন্যদিকে উন্নয়নের ঢেউ প্রান্তিক ও ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীকে চুম্বকের মত টেনে আনছে নগরে। ফলে নগরীর জনসংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে। জন শুমারির প্রামাণ্য সামপ্রতিক হিসাব না থাকলেও ঘন বসতি, অভিজাত আবাসিক ও বস্তি এলাকায় সীমিত নমুনা জরিপে দেখা গেছে, নগরীর জনসংখ্যা ৭০ লাখের বেশি। নগরীর প্রথম নির্বাচিত সিটি মেয়র চট্টল কিংবদন্তি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রথম মেয়াদে (‘৯৩ সাল) এই সংখ্যা ছিল ৩০ লাখের মত। তাঁর শেষ মেয়াদ অর্থাৎ ২০০৯ এ প্রায় ৫০ লাখ।
প্রায় ১৭ বছর টানা নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদা দেন সরকার। কিন্তু পরবর্তী মেয়ররা এ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। অথচ ঢাকার দুই সিটি মেয়র পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করছেন। এটা উন্নয়ন কাজ সমন্বয়ে এখন অন্যতম প্রধান বাধা। কারণ একমাত্র নির্বাচিত জন প্রতিনিধি ও বড় প্রতিষ্ঠান সিটি মেয়রের সরকারি মর্যাদা ঝুলে থাকায় তিনি নগরীর সব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে সমন্বয় সভা আহবান করলেও সংস্থাগুলোর সাড়া কম। চুক্তিতে নিয়োগকৃত প্রধান বা সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিনিধি পাঠিয়ে দায় সারেন। এতে নগর উন্নয়নের সমন্বয় এক বিন্দুতে কোনভাবেই মিলছেনা। সংস্থা প্রধানদের ব্যক্তি অহং এর জন্য দায়ী। মূল্য গুণছেন অসহায় ৭০ লাখ নাগরিক। সিটি মেয়রকে পূর্ণমন্ত্রীর পদ মর্যাদা দেয়া হলে অহংএর বাঁধ ভাঙতোই। তিনি সরকারি মর্যাদা ব্যবহার করে সবাইকে এক ছাতার নিচে জড়ো করতে পারতেন। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমল থেকে আমরা চট্টগ্রামের এই দাবি বহুবার কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছি। বলা হয়, সিজেকেএস সেক্রেটারিসহ তিনি মর্যাদার সাথে সঙ্গতিহীন কিছু পদ ধরে রাখায় বিষয়টা ঝুলে যায়। অথচ এটা চট্টগ্রামের মানুষের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন। সাথে সাথে বিশাল বিশাল উন্নয়ন মহাপ্রকল্পের গতি দ্রুততর করে জনভোগান্তি নিরসন ও বিপুল অপচয় রোধ করার সমাধানও বটে।
মনে রাখা উচিত মেয়র ব্যক্তি নন, নগরীর সর্বোচ্চ সম্মানজনক নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান।মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ৩০/৩৫ লাখ জনসংখ্যার নগরে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেলে ৭০ লাখ জনসংখ্যার মেয়র পূর্ণমন্ত্রীর পদ মর্যাদা কেন পাবেন না? ঢাকার দু’ মেয়রের উদাহরণতো আছেই। বর্তমান সিটি মেয়র ঝুলে থাকা মর্যাদা ফিরে পেলে নগর উন্নয়ন মহাপ্রকল্পগুলোর উন্নয়নে গতি আসার পাশাপাশি বাধাহীন সমন্বিত উন্নয়ন নিশ্চিত হতে বাধ্য। বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম নগরবাসীর অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে বৃহত্তর উন্নয়নের বাধা দূর করতে মেয়রকে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করবেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট