প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ফেরত চায় চসিক

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পত্র

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ফিরে পেতে চায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর অংশ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে সংস্থাটি। চসিকের অর্থায়নে ২০০১ সালে গড়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়টি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। পদাধিকার বলে চসিক চেয়ারম্যান ছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। তবে ‘২০১৯ সালে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেয়’ দাবি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিক পত্র দিয়ে জানিয়েছে চসিক। এতে চসিকের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমতি চাওয়া হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখেছি। মন্ত্রণালয় যেভাবে নির্দেশনা দিবে আমরা সেভাবে কাজ করব। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিকানা সিটি কর্পোরেশনের। এটি বেদখল হয়ে গেছে, আমরা আবার ফেরত চাই। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এর বেআইনী ও অবৈধভাবে জোরপূর্বক দখলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কর্পোরেশনের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার অনুমতি চেয়েই মূলত আমরা লিখেছি। এ বিষয়ে জানার জন্য প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এর মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, ২০০০ সালে প্রবর্তক মোড়ের হিজরা খালের নালার পাশে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভবনটি নির্মিত হয়। শুরুতে একটি ভবন নির্মাণ করে নিচতলায় দোকান ভাড়া দেওয়া হয়। পরে কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ইনস্টিটিউট অব বিজনেস টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০২ সালে এটিকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলাকালে প্রথম ভবনটি ভাঙা হয়। বর্তমানে জিইসি, ওয়াসা, হাজারীগলিতে নিজস্ব ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসন চৌধুরী নওফেলের বাবা চসিকের সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০০১ সালের মে মাসে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব প্রেরণ করেন। প্রস্তাবটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অধীনে অনুমোদিত হলে ইউজিসি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠদান অনুমোদন করে। ২০০১ সালের ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। ২০০২ জানুয়ারি থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। এক সময় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে চসিকের লোগো ছিল। চসিকের বিভিন্ন নথিপত্রেও এটি চসিকের মালিকানাধীন বলে দাবি করা হয়।

কর্তৃত্ব ফিরে পেতে চায় চসিক : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার লেখা দাপ্তরিক পত্রে বলা হয়, চসিকের উদ্যোগে ও অর্থায়নে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে চসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করে আসছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সংক্রান্ত ট্রাস্ট দলিল অনুসারে কর্মরত মেয়র পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে।

এ ধারাবাহিকতায় সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ঘাটতি দূর করার জন্য চসিকে পত্র প্রেরণ করে। তখন হঠাৎ করে আশ্চর্যজনকভাবে সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে দাবি করেন।

মন্ত্রণালয়ে দেয়া চিঠিতে চসিক দাবি করে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক ইস্যুকৃত পত্রটি চ্যালেঞ্জ করে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগে রীট মামলা (১২৮৯২/২০১৫) দায়ের করে। ২০১৬ সালের ১২ জুন মামলাটিও খারিজ হয়ে যায়। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মহিউদ্দিন চৌধুরী মহামান্য আপীল বিভাগে সিভিল পিটিশন (৩১৪৩/২০১৭ ) দায়ের করলে আপীল বিভাগ ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি সিভিল পিটিশনটিও খারিজ করে দেয়। এভাবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমেও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সিটি কর্পোরেশনের হাতেই ন্যস্ত আছে।

চসিকের পত্রে বলা হয়, চসিকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়মতান্ত্রিক ও আইনগতভাবে নিজেদের কর্তৃত্বে নেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেয়। পত্রে চসিক উল্লেখ করে, ছাত্রজনতার আন্দোলনের ফলে বর্তমানে একটি জনকল্যাণমূলক অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপটে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়টি চসিকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য কর্পোরেশনের প্রতি লিখিত আবেদন করেছে। চসিকের কর্মকর্তাকর্মচারীগণও নিজেদের ত্যাগতিতিক্ষা ও অর্থায়নের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় সিটি কর্পোরেশনের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে আনার পক্ষে।

শুরুতে আপত্তি ছিল না মহিউদ্দিন চৌধুরীর : প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চসিকের আভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, ভূমি ক্রয়, ক্যাম্পাস নির্মাণসহ যাবতীয় খরচ চসিকের তহবিল থেকে প্রদান করা হয়। চসিকের মেয়রই পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রথম পর্যায়ে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১০ সালে এম মনজুর আলম মেয়রের দায়িত্ব নিলে নিয়মানুসারে ট্রাস্টি বোর্ডেরও পরিবর্তন আসে এবং মনজুর আলম ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ওই ট্রাস্টি বোর্ডে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সদ্যবিদায়ী মেয়র হিসেবে সদস্য হন এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সকল মিটিং ও কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থেকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা এবং উন্নয়নে চসিককে সহায়তা করেন। তখন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা, উদ্যোক্তা, পরিচালনাসহ কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তুলেননি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচলনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সকল কাজে সম্মতি ও সহয়তা দেন।

যেভাবে চসিকের হাতছাড়া হয় : ২০১৫ সালের জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুির কমিশন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাটতি পূরণে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে দাপ্তরিক পত্র দেন। তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী চসিক মেয়র বরাবর দেয়া পত্রকে অবৈধ ও আইন বহির্ভূত দাবি করে হাইকোর্টে রীট মামলা দাখিল করেন।

চসিকের আইন শাখার তথ্য অনুযায়ী, এই রীট মামলার প্রেক্ষিতে আদালত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কোনো ধরনের কাজ কর্মে হস্তক্ষেপ না করার জন্য অন্তবর্তী নিষেধজ্ঞা আদেশ প্রদান করেন।

এছাড়া ওই রীট মামলায় মহিউদ্দিন চৌধুরী তাকে উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গন্য করে ট্রাস্ট দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রিকরণের ক্ষমতা প্রদান, ট্রাস্টি দলিলে তাকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঘোষণা এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। শুনানি শেষে আদালত ২০১৬ সালের ১২ জুন এ মামলার রায় দেন। এতে মামলা চলাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ২০১৫ সালে চসিকে যে পত্র দেয় তা বাতিল করে। ফলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ওই পত্রের অবৈধ ঘোষণার যে আবেদন করে তা অকার্যকর হয়ে যায় এবং আদালতও তা খারিজ করে রায় প্রদান করেন।

এদিকে হাইকোর্ট ডিভিশন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করে ট্রাস্টি দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রিকরণের ক্ষমতা প্রদান, ট্রাস্টি দলিলে তাকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঘোষণা এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে অংশ গ্রহণের অনুমতি চেয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনটি জুডিশিয়াল রিভিউএর এখতিয়ারে পড়ে না বলে তাকে পরামর্শ দেন। এছাড়া বিষয়টি সুরাহার জন্য দেওয়ানী আদালত যথাযথ ফোরাম বলে মতামত দেয়। একইসঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনটিও খারিজ করে রায় প্রদান করে।

এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগ চসিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারে না বলে একটি অবজারভেশন প্রদান করে। অবশ্য চসিক সেটা প্রত্যাহারের জন্য একই আদালতে রিভিউ পিটিশন দায়ের করেন। রিভিউ পিটিশনটি মঞ্জুর করে আদালত ২০১৭ সালের ৬ মে রায় দেয়। এতে ‘চসিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারে না’ বলে দেয়া প্রদত্ত বক্তব্যটি আদালতের মন্তব্য উল্লেখ করে এটি কোনো পক্ষের উপর বাধ্যকর নয় বলে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০১৭ সালের ৬ মে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে লীভ টু আপীল মোকদ্দমা দায়ের করে। অবশ্য ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শুনানিতে বাদী পক্ষে কেউ উপস্থিত না থাকায় আপীল বিভাগ লীভ টু আপীল খারিজ করে দেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবহির্নোঙরে পণ্য খালাস বন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধসরকারকে সহায়তার আলোচনা করতে আজ আসছেন ডোনাল্ড লু