প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ফেরত পেল চসিক

মেয়রকে চেয়ারম্যান করে ৯ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়রকে চেয়ারম্যান (পদাধিকার বলে) করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এর ফলে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজ’র চেয়ারম্যান হলেন। অর্থাৎ তার নেতৃত্বে গঠিত বোর্ডের অধীন পরিচালিত হবে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। একইসঙ্গে দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর পর ‘বেদখল’ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃত্ব ফেরত পেল চসিক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়এর উপসচিব মোছা: রোখছানা বেগম স্বাক্ষরে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এর কাছে দেয়া পত্রটিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনক্রমে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এর ৩৫ () ধারা অনুযায়ী বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টিজের পরিবর্তে একই আইনের ৬ () ধারা অনুযায়ী বোর্ড অব ট্রাস্টিজ পুনর্গঠন করা হলো।

পত্রটি সূত্রে জানা গেছে, পুনর্গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের বাকি সদস্যরাও নির্ধারিত হবেন পদাধিকার বলে। এরা হচ্ছেনচসিকের সদ্য সাবেক মেয়র, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব, চসিকের শিক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, চসিকের দুই প্যানেল মেয়র এবং চসিকের হিসাব ও নিরীক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান। এদিকে চসিকে বর্তমানে প্যানেল মেয়র এবং স্থায়ী কমিটি নেই। এছাড়া ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন সদ্য সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। গত ৬ ডিসম্বর থেকে শূন্য আছে উপাচার্য পদটিও। ফলে নবগঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের ৬ সদস্যের পদই খালি থাকবে। অবশ্য গত সোমবার উপচার্য নিয়োগে তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। খুব শীগ্রই উপচার্য নিয়োগ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলে, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মেয়র মহোদয় সভা আহ্বানের নির্দেশ দিয়েছেন। সভায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তিনি বলেন, এখন প্যানেল মেয়ররা নেই, কিন্তু স্থায়ী কমিটিগুলো গঠন করা সম্ভব। সেগুলো গঠন হলে স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানদের পাওয়া যাবে।

৯ বছর পর কর্তৃত্ব ফেরত পেল চসিক : চসিকের উদ্যোগ ও অর্থায়নে গড়ে ওঠলেও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালেয়র কর্তৃত্ব ২০১৬ সালে হাতছাড়া হয় সংস্থাটির। তখন এটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সাবেক মেয়র এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তার পরিবার। ২০১৯ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেয়’ দাবি করে ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয় চসিক।

নওফেল ছাড়াও বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন ও ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন, এস আলম গ্রুপের তিন কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ, আবদুস সামাদ লাবু ও মোহাম্মদ শহীদুল আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব বড়ুয়া, নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আওয়ামী লীগ নেতা রেমন্ড আরেং, প্রকৌশলী শহীদুল আলম এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মূসাও ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায়।

জানা গেছে, চসিকের তৎকালীন মেয়র প্রয়াত এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০০১ সালের মে মাসে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব প্রেরণ করেন। প্রস্তাবটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অধীনে অনুমোদিত হলে ইউজিসি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠদান অনুমোদন করে। ২০০১ সালের ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। ২০০২ জানুয়ারি থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। একসময় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে চসিকের লোগো ছিল। চসিকের বিভিন্ন নথিপত্রেও এটি চসিকের মালিকানাধীন বলে দাবি করা হয়।

চসিকের অর্থায়নে ২০০০ সালে প্রবর্তক মোড়ের হিজরা খালের নালার পাশে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভবনটি নির্মিত হয়। শুরুতে একটি ভবন নির্মাণ করে নিচতলায় দোকান ভাড়া দেওয়া হয়। পরে কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ইনস্টিটিউট অব বিজনেস টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০২ সালে এটিকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলাকালে প্রথম ভবনটি ভাঙা হয়। বর্তমানে জিইসি, ওয়াসা ও হাজারী গলিতে নিজস্ব ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চসিকের আভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চসিকের মেয়রই পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রথম পর্যায়ে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১০ সালে এম মনজুর আলম মেয়রের দায়িত্ব নিলে নিয়মানুসারে ট্রাস্টি বোর্ডেরও পরিবর্তন আসে এবং মনজুর আলম ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ওই ট্রাস্টি বোর্ডে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সদ্যবিদায়ী মেয়র হিসেবে সদস্য হন এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সকল মিটিং ও কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থেকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা এবং উন্নয়নে চসিককে সহায়তা করেন।

তবে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ঘাটতি দূর করার জন্য চসিকে পত্র প্রেরণ করে। এতে উপাচার্য, উপউপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য প্যানেল প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে কমিশনকে অবহিত করতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে চসিক একই বছরের ১১ নভেম্বর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি দলিল সম্পাদন করে কমিশন বরাবর প্রেরণ করে। তখন হঠাৎ করে মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে দাবি করেন। একইসঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরী চসিক মেয়র বরাবর দেওয়া পত্রকে অবৈধ ও আইন বহির্ভূত দাবি করে হাই কোর্টে রিট মামলা দাখিল করেন। ওই রিট মামলায় মহিউদ্দিন চৌধুরী তাকে উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করে ট্রাস্ট দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রিকরণের ক্ষমতা প্রদান, ট্রাস্টি দলিলে তাকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঘোষণা এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। শুনানি শেষে আদালত ২০১৬ সালের ১২ জুন এ মামলার রায় দেন। এতে মামলা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ২০১৫ সালে চসিকে যে পত্র দেয় তা বাতিল করে। ফলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ওই পত্রের অবৈধ ঘোষণার যে আবেদন করে তা অকার্যকর হয়ে যায় এবং আদালতও তা খারিজ করে রায় প্রদান করেন।

এদিকে হাই কোর্ট ডিভিশন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করে ট্রাস্টি দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রিকরণের ক্ষমতা প্রদান, ট্রাস্টি দলিলে তাকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঘোষণা এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে অংশগ্রহণের অনুমতি চেয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনটি জুডিশিয়াল রিভিউর এখতিয়ারে পড়ে না বলে তাকে পরামর্শ দেয়। এছাড়া বিষয়টি সুরাহার জন্য দেওয়ানী আদালত যথাযথ ফোরাম বলে মতামত দেয়। একইসঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনটিও খারিজ করে রায় প্রদান করে।

সর্বশেষ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি গঠনের অনুমোদন চিঠি চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর করা রিটের রায়ের কার্যকারিতা গত ২৪ ডিসেম্বর স্থগিত করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়ের করা সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল মামলার শুনানিতে এ স্থগিতাদেশ প্রদান করেন বিচারপতি মো. রেজাউল হক।

আইনজীবীরা ওইদিন বলেন, স্থগিতাদেশের ফলে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চসিকের অধীনে পরিচালনায় আর কোনো বাধা নেই। গতকাল মেয়রের নেতৃত্বে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের ফলে আনুষ্ঠানিকভাবেই প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ফেরত পেল চসিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা আজ
পরবর্তী নিবন্ধজুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় যা বলা হয়েছে