শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যায় ফেনী জেলার জনগণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, জমির ফসল, পুকুরের মাছ, গবাদিপশু থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছু বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে পানি নামার পর প্রত্যেকটা এলাকাকে বিরান ভূমির মত মনে হচ্ছে। চারদিকে শুধু বিধ্বস্ততা ও ধ্বংসের ছাপ। এর মধ্যে শুরু হয়েছে মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামতের কাজ। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে নতুন করে জীবন সংগ্রামে।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শস্য ক্ষেত। পানিতে তলিয়ে গেছে মোট আবাদকৃত জমির প্রায় ৯৭%। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৭৯০ কৃষক পরিবার। উত্তরের এলাকার পানি নেমে গেলেও এখনো সোনাগাজী ও দাগনভূঁইয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানি রয়ে গেছে। মোট ২৩ জন মানুষ মারা গেছে। কৃষি দপ্তর তথ্য অনুযায়ী, ফেনীতে এবছর ৩২,৪৮৬ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। এর মধ্যে ৩১,১৪৫ হেক্টর আমন ধান পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া ২,০৭৩ হেক্টর বীজতলার মধ্যে ২,০৪২ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২,৬৪৮ হেক্টর আউশ ধানের মধ্যে ১,৮৪৫ হেক্টর আউস ধান তলিয়ে গেছে। যার প্রায় পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে, কারণ আউশ ধান তোলার আগ মুহূর্তে এই বন্যাটি হয়। শুধু ধানে মোট ক্ষতি ৪৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৪২ হেক্টর ফল বাগান, ৫২৫ হেক্টর সবজি, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ ও ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মোট ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যায় শুধু কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে ৫২৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
অন্যদিকে জেলার ৩২৪ টি সড়কের প্রায় ৫০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ফেনী সদরে ৯০ কিমি, দাগনভূঁইয়ায় ৯০কিমি, সোনাগাজীতে ৯৫ কিমি, পরশুরামে ৮৫ কিমি, ফুলগাজী ৭০ কিমি ও ছাগলনাইয়ায় ৭০কিমি সড়ক ভেঙে গেছে। কোনো কোনো জায়গার রাস্তার মাটিসহ রাস্তার কিয়দংশ বিলীন হয়ে গেছে। যা মেরামত করতে অন্তত ৫০–৬০ কোটি টাকা খরচ হবে।
এদিকে পানি নামার সাথে সাথে শুরু হয়েছে পানি বাহিত রোগ ডায়রিয়া। প্রতিদিন ছয় উপজেলা থেকে শত শত ডায়রিয়া রোগী আসছে হাসপাতালে। মূলত ২৫ আগস্ট থেকে ডায়রিয়া রোগী আসা শুরু হয়েছে। তবে পানি যত নামছে রোগীর সংখ্যা তত বাড়ছে। ২৫০ শয্যার ফেনী সদর হাসপাতালের বেডে রোগী রেখে আশেপাশে খোলা চত্বরেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীর চাপে ডাক্তারদের অবস্থা কাহিল। তারা রাতদিন চিকিৎসা দিয়েও রোগী শেষ করতে পারছে না। জানা যায় ফেনী সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যা হলো ১৮টি। কিন্তু প্রতিদিন রোগী আসছে প্রায় ২০০–৩০০। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। লোকবল সংকটের কারণে সেবা কার্যেও বিঘ্ন ঘটছে। এ ছাড়া মেডিকেল অফিসারের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। আছে নার্সের সংকট, ওষুধের সংকটও রয়েছে। আবার হাসপাতালটি বন্যায় ডুবে গিয়ে বেশ কিছু ওষুধ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ কারণে রোগীদের কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।
এবারের বন্যায় ৯৫১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। জেলায় ৩৫১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা, ৫৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৪১টি কলেজ রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৮২ হাজার। এখনো অর্ধেকের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। জেলার প্রাথমিক কোনো বিদ্যালয়ে এখনো পাঠদান শুরু হয়নি। কিছু কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে পাঠদান শুরু হলেও উপস্থিতি কম। তবে কতটি প্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু হয়েছে, তার হিসাব সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে নেই। তবে যেসব বিদ্যালয় পরিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোতে পাঠদান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন জানায়, টাকার অঙ্কে প্রতিষ্ঠান গুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ সময় সাপেক্ষ। নষ্ট হয়েছে আসবাব, শিক্ষা উপকরণ, ভবন, সীমানা প্রাচীর ও নলকূপ। এসব কারণে পাঠদান শুরু করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দাগনভূঁইঞা ও সোনাগাজী উপজেলার অনেক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় এখনো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৩৫টি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব জেলা প্রশাসনের কাছে জমা হয়েছে। তবে এখনো কয়েকটি উপজেলা থেকে হিসাব আসেনি। এতে ১৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ৪১ কলেজের সব কটিতে পানি ঢুকেছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় তিন কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয় বলে জানা যায়।
এবারের ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলাজুড়ে প্রায় ৬৭ হাজার ২৮৭ হাজার কাঁচাপাকা ঘর, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বানভাসি মানুষের আনুমানিক ৬৯২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বসতবাড়িতে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে ঘর মেরামতের ব্যয়, আসবাবপত্রের ক্ষতি ও নিত্য ব্যবহার্য বৈদ্যুতিকসামগ্রী মেরামতের ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জেলায় বন্যায় আসবাব পত্র বৈদ্যুতিক সামগ্রীর সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফুলগাজীতে। সবচেয়ে কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দাগনভূঁইঞা এবং সোনাগাজীতে। এ দুই উপজেলায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এছাড়া ফেনী সদরের কালীদহ ইউনিয়ন, মোটবী ইউনিয়ন এবং ধর্মপুরে সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে। এ তিনটি ইউনিয়নে ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সদর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
এবারের ফেনীর ভয়াবহ বন্যাটি ভারতের মনিপুর ও বাংলাদেশের অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও ভারতের কালসি বাঁধের ছেড়ে দেওয়া পানির জন্য হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত কোনোরকমের পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বাঁধের পানি ছাড়াতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। তাই ভারতের সাথে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করা জরুরি এবং প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। অন্যদিকে মুহুরি ও ফেনী নদী ও এর শাখা নদীগুলোর খনন ও নদীর দখলকৃত অংশ উদ্ধার করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। মনে রাখতে হবে, পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়লে হঠাৎ আসা পানিতে এতো ক্ষয়ক্ষতি হবে না। অন্যদিকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের বাড়ি–ঘর মেরামত ও তৈরির ব্যবস্থা করা। দরকার হলে অবকাঠামোগত ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সুদ মুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সরকার যত দ্রুত এগিয়ে আসবে প্রান্তিক মানুষের কষ্ট তত তাড়াতাড়ি লাঘব হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।