চোখে–মুখে বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা স্পষ্ট। অন্য আট–দশটা সাধারণ ছাত্রের মতো বেঞ্চে বসেই এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তবে দুই হাত নেই রফিকুল ইসলাম রাব্বি (১৬) নামে এই শিক্ষার্থীর। ৭ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় দুটি হাতই হারাতে হয়েছে তাকে। তবুও থেমে যায়নি রাব্বি। সব বাধা জয় করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ফৌজদারহাট কে এম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পায়ের দুই আঙ্গুল দিয়ে কলম ধরে মনোযোগ সহকারে পরীক্ষার খাতায় লিখে যাচ্ছে সে। এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র সচিব ফৌজদারহাট কে এম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থী রাব্বি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। তাকে শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী ৩০ মিনিট সময় অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে বাড়তি সময় নিচ্ছে না। যথাসময়ের মধ্যেই তার লেখা শেষ হয়ে যায়। ভাটিয়ারী ইউনিয়নের পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামের দিনমজুর বজলুর রহমানের ছেলে রাব্বি। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। সে ভাটিয়ারী হাজী টিএসি উচ্চ বিদ্যালয় ছাত্র। গতকাল অনুষ্ঠিত ইংরেজি ২য় পত্রের পরীক্ষা শেষে কথা হয় অদম্য এই ছেলের সঙ্গে। রাব্বি বলে, পরীক্ষায় তার সব প্রশ্ন কমন এসেছে। ভালো উত্তরও করে এসেছে। মনে বিন্দুমাত্র কোনো হতাশা নেই। লেখাপড়া করে বড় হয়ে সরকারি চাকরিজীবী হবে। অভাব মেটাতে চায় সংসারের। হাসি ফোটাতে চায় বাবা–মায়ের মুখে। করতে চায় দেশের সেবা। সব বাধা–বিপত্তি দূর করে ভবিষ্যতে সে উচ্চশিক্ষিত হয়ে মানুষের মতো মানুষ হতে চায়।
ভাটিয়ারী হাজী টিএসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি রবিন্স কুমার দাশ রবি বলেন, রফিকুল অত্যন্ত মেধাবী। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় মুখ দিয়ে লিখে ৪ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট পেয়েছিল সে। তাকে দমিয়ে রাখা যাবে না। সে প্রাথমিক সমাপনীতে মুখ দিয়ে লিখলেও এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে পা দিয়ে লিখে।
ভাটিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গাজী হুমায়ুন কবির বলেন, অন্য আট–দশটা ছেলের মতো তারও দুটি হাত ছিল। সে খুব ভালো মেধাবী ছাত্র। রাব্বির জীবনে ঘটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে ছিল রাব্বি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার্থী। ওই বছরের ৫ অক্টোবর ভাটিয়ারী বাজার এলাকায় ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণকাজ চলছিল। শ্রমিকেরা পুরো কাজ শেষ না করে ব্রিজটি খোলা রাখে। ওই দিন দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে কিছু শিক্ষার্থী স্কুল থেকে বের হয়ে বাজারে যায়। রাব্বি ওভারব্রিজ খোলা পেয়ে তার মধ্য দিয়ে পারাপার করতে যায়। সে সময় পাশে থাকা বিদ্যুৎ লাইনের সঙ্গে লেগে মারাত্মকভাবে দগ্ধ ও আহত হয়।
রাব্বির বাবা বজলুর রহমান বলেন, সেদিন দুর্ঘটনার পর তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যান। কিন্তু তার কাছে কোনো টাকা পয়সা ছিল না। পরে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নুরুচ্ছাফা তাকে পাঁচ হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পাশের স্কুল–কলেজ থেকে কিছু সহযোগিতা আসে। সাজেদা আলম বিদ্যানিকেতনের চেয়ারম্যান বিশেষ সহযোগিতা করেন। সবার সহযোগিতা ও নিজের জমিজমা বিক্রি করে প্রায় ৯ লাখ টাকা খরচ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন ছেলেকে।
বজলুর রহমান জানান, হাত দুটি কেটে ফেলার পর অনেক দিন কেঁদেছিল রাব্বি। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর সে বই নিয়ে পড়তে বসতে চায়। কিন্তু লিখতে পারে না, বইয়ের পাতা উল্টাতে পারে না। এ জন্য হতাশায় কান্না করত। এই একটি ফুট ওভারব্রিজ তার ছেলের সুন্দর স্বাভাবিক জীবন, সুন্দর ভবিষ্যৎ কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেন, ছেলেকে ভালো করতে সহায়–সম্পদের প্রায় সবটুকু বিক্রি করে দিয়েছি। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে কীভাবে তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করব। এ জন্য সবার সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেছেন তিনি।