কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া উপজেলার বড়ইতলি গ্রামের প্রীতিরানী দাস ও সনাতন দাসের দুই ছেলের মধ্যে ছোটটি দীপঙ্কর যেদিন গ্রামে পড়ার পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে বা বাড়ায়, স্বপ্ন সেদিন আকাশ ছোঁয় তাঁদের। বড় পুত্র শুভঙ্কর রোগাভোগা, একটু আলাভোলাও; লেখাপড়া হয়নি তেমন। বাড়ির সামনে সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা টানা পথ গিয়ে বড় রাস্তায় মিশেছে। দুই ধারে লাউয়ের মাচা, পানের বরজ। সে পথ দিয়েই বাড়ি ছাড়ে দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ। দু’হাজার পনের সালের কথা। এইতো কয়েক দিন আগে ওদের এম এ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হল। ঠিক এই দিনটির প্রতীক্ষায় ছিলেন মা-বাবা। কিন্তু না, তাঁদের প্রতীক্ষার পালা ফুরিয়ে যায় তিন বছর আগেই। দু’হাজার সতের’র আঠারোই ডিসেম্বর সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা সেই টানা পথ দিয়ে মায়ের কাছে ফিরে গিয়েছে নিথর দেহের নিষ্প্রাণ দিপঙ্কর। তিন বছর আগে এমন দিনে নগরীর এক অনুষ্ঠানে মধ্যাহ্নভোজনের প্রাক্কালে পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই নিস্তেজ হয়ে যায় দশ-দশটি তাজা প্রাণ। তাদের একজন দীপঙ্কর। সদ্য প্রয়াত চট্টল বীরের স্মরণে আয়োজিত ভোজসভার প্রবেশ পথে কি এমন ঝড় উঠেছিল যে দশ দশটি পূর্ণ-বয়স্ক মানুষ নিমিষেই নাই হয়ে গেল! হারিয়ে যাওয়ার দিন সাতেক আগে দেখা হয়েছিল দীপঙ্করের সঙ্গে। তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ করে ফুরফুরে মেজাজে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পরীক্ষা শেষ, বাড়ি যাবেনা?- প্রশ্নটা শুনেই মাথা চুলকে বলে ওঠে “যাব ম্যাডাম, পরের সপ্তাহে”। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের মিলনায়তনে চাকরি-বাকরি সংক্রান্ত কী একটা কর্মশালায় যোগ দিয়ে ফিরছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদুঘর মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই আর আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখে আসতে বললাম ওদেরকে – শহীদ আব্দুর রব, শহীদ ফরহাদ আমাদের ইতিহাস বিভাগেরই ছাত্র। ওঁদের ছবি আছে প্রদর্শনীতে। যাচ্ছি বলেই ঘুরে দাঁড়ায় দীপঙ্কর। আঠারো তারিখ আমার প্রবন্ধ পাঠের দিন। নোটিশ বোর্ডে দেখেছে সে। কথা দেয় সে আমায় – ঠিক চলে আসবে যথাসময়ে।তখনও চট্টগ্রামের রাজনীতির প্রাণপুরুষ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বেঁচে আছেন, জীবন্মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। পনেরই ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় চট্টগ্রামের জীবনধারা, বদলে যায় চট্টলবাসীর দিনপঞ্জি। দীপঙ্করও শিক্ষককে দেওয়া কথা ভুলে আঠারো তারিখ সকালে ইতিহাস বিভাগের সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত না হয়ে নেতার স্মরণে আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দিতে মনস্থ করে। রীমা কমিউনিটি সেন্টারের বিশেষ আয়োজনটা ছিল কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য। মেজবান খাওয়ার সুযোগ সচরাচর আসে না তাদের। সম্মেলন কক্ষে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাত্তর জুড়ে ছাপানো প্রতিবেদনগুলোর ওপর নির্ভর করে কি আলোচনা আলোচনা চলে, না জানলেও জীবন চলে যাবে! কিন্তু এমন ভূড়িভোজনের সুযোগ জীবনে হয়তো আর নাও আসতে পারে! এই লোভ সামলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পা বাড়াতে পারেনি সেদিন দীপঙ্কর। আঠারো তারিখ সন্ধ্যায় দীপঙ্করের মৃত্যুসংবাদ যখন আমার কানে আসে তখন সময় মিলিয়ে দেখি; প্রবন্ধ উপস্থাপনা শেষে মঞ্চ থেকে নেমে যাই যখন, ঠিক তখনই রীমা কমিউনিটি সেন্টারের ফটকে শত শত মানুষের পায়ের তলায় পড়ে নিস্তেজ হয়ে যায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতার সুঠামদেহি যুবক দীপঙ্করসহ আরও নয়টি তাজা প্রাণ। এমন মৃত্যুতে শোকাভিভূত হওয়ার দিন আমরা বোধহয় পেরিয়ে এসেছি। কত প্রকারের মৃত্যুই তো দেখি প্রতিদিন; অগ্নিদগ্ধ, গুলিবিদ্ধ, ছুরিকাহত, গলাকাটা, টুকরো টুকরো, বস্তাবন্দী, জলেডোবা… কত না লাশের খবর আসে। আমরা নির্বিকার থেকেই অভ্যস্ত। দীপঙ্কর আমার ছাত্র বলেই হয়তো এমন বেঘোরে ওর মরে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে পারি না। শ্রেণীকক্ষে, আবদুল করিম ভবনের বারান্দায়, সিঁড়িতে, গ্রন্থাগার চত্বরে যখন-তখন দেখতে পাই ওর হাসিমাখা মুখ- ‘যেখান দিয়ে হেসে গেছে হাসি তার রেখে গেছে রে…’। লম্বা চওড়া সুদর্শন যুবক এক দুপুরে ভাত খেতে গিয়ে মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল! প্রীতিরানীর দিনরাত্রিগুলো কেমন করে কেটে যায়, ভাবতেই অন্তঃসারশূন্য মনে হয় পৃথিবীর যাবতীয় আয়োজন। অজান্তেই ভিজে ওঠে চোখের কোনা। তাঁর বুকের তোলপাড়ের নিখুঁত ছবি বোধ করি পৃথিবীর সেরা কথাসাহিত্যিকও আঁকতে পারবে না। আজও সোনাঝরা রোদের হাসি দীপঙ্করদের বাড়ির উঠোন জুড়ে। মাটির দেয়ালের কয়েক কামরার ঘরের সামনের এই উঠোনে হেসেখেলে বড় হয়েছিল দীপঙ্কর। ছবি তোলার বড় শখ ছিল ওর। মাটির ঘরের দেয়াল জুড়ে ওর টগবগে প্রাণবন্ত ছবিগুলোকে বড় জীবন্ত মনে হয়। মনে হয়, এই বুঝি ছবি থেকে বের হয়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরবে, কিংবা নতুন বউদি’র সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠবে। ছুটিতে এলে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। এখন এ বাড়িতে রাজ্যের নিস্তব্ধতা। উঠোনের এক কোণে গোয়াল ঘরের বাসিন্দারাও যখন তখন ডেকে ওঠে না। সাদাসিধে বড় ভাই শুভঙ্করই এখন মায়ের একমাত্র অবলম্বন। শুভঙ্কর এসেছে হারানো ভাইয়ের চেনা জগতে। তবে ছাত্র হিসেবে নয়, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে, তাও আবার অস্থায়ী পদে। ছুটিতে বাড়ি যায় শুভঙ্করও। তবে বাড়িটা আর আগের মতো হাসে না। বড়ইতলি গ্রামের এক আটপৌরে মায়ের স্বপ্নভঙ্গের গল্প আমাদের সমাজে চলমান আনুষ্ঠানিকতার উন্মাদনার এক নির্মম চিত্র ফুটিয়ে তোলে। উৎসবের নৃশংসতা ও উদযাপনের ঘনঘটায় জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নকে এড়িয়েই এগিয়ে চলেছে আমাদের জীবনধারা।