প্রকৃতি, প্রাকৃতিকতা, আত্মা ও আধ্যাত্মিকতা এক সুতোয় আবদ্ধ। প্রকৃতির সাথে স্রষ্টা, আত্মার সাথে মহাত্মা মিশে আছে। অতএব যেখানে প্রাকৃতিকতা সেখানে আধ্যাত্মিকতা, সেখানেই স্রষ্টায়ত্ত। স্রষ্টা সৃষ্টিকে নির্মাণে সময় তিন প্রকারের শক্তি ও রং দ্বারা প্রকৃতির বিস্তার করেন। যথা- সত্ত্ব, রজস, তমস। আল্লাহর বিশেষ কৃপায় সৃষ্ট বলে ভারতবর্ষের প্রকৃতি জুড়ে এই তিন প্রকার রঙের মিশ্রণ পাওয়া যায়। এটি ‘ভারত’শব্দের প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ থেকেই বুঝা যায়। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ লোকই বিশ্বাস করে যে শকুন্তলা ও দুষ্মন্তপুত্র ‘ভরত’ এর নামানুসারে ভারতের নামকরণ হয়। মূলত সঠিক তথ্য রয়েছে পবিত্র বেদ গ্রন্থে, যা প্রাচীন মুনি- ঋষিগণ বলে গেছেন। ‘ভা’ অর্থ জ্ঞান, এবং ‘রত’ অর্থ নিমগ্ন থাকা। অর্থাৎ জ্ঞানে নিমগ্ন থাকার নামই ভারত। বেদ গ্রন্থ যখন রচিত হয় তখন শকুন্তলা পুত্র ভরতের জন্মও হয়নি। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষের মানুষ প্রকৃতির রহস্য ও উৎস জানার লক্ষ্যে জ্ঞান সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন।
তাঁরা সাধনার মাধ্যমে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনসহ আল্লাহর দর্শন করে অধ্যাত্মিক জ্ঞানে জ্ঞানী হন এবং এই জ্ঞান গুরু শিষ্য পরম্পরায় আমরা পেয়েছি। এর চর্চা এখনো অব্যাহত। এইজন্য ভারতবর্ষে যত আধ্যাত্মিক ব্যক্তির জন্ম হয়েছে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয়নি। তাঁরা প্রকৃতিতে মিশে এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং আমাদের শিখিয়েছেন প্রকৃতির সুরক্ষাসহ কীভাবে ভালবাসতে হয়। এইজন্য প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল। পশ্চিমা রাষ্ট্র সমূহ যেভাবে প্রকৃতির শোষণ ও কার্বন নিঃসরণসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে, এর শতভাগের একভাগও ভারতবর্ষের মানুষ করে না।
আবার ‘ভারত ‘শব্দের ভৌগোলিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখি- ‘ভা’ অর্থ সাদা, রজস অর্থ গেরুয়া এবং তমস অর্থ কালো। অর্থাৎ মূল প্রকৃতির রংয়ের বহিঃপ্রকাশ ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক পরিবেশে রয়েছে বলেই ঋষিগণ এর নাম ভারত রেখেছেন। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ খেয়াল করলে দেখি-এর উত্তরে হিমাচল,কাশ্মীর পাকিস্তান। এসব অঞ্চলের পরিবেশের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই এর অধিকাংশ পাহাড়-পর্বত বরফাচ্ছাদিত। অর্থাৎ সাদা। এখানকার পশুপাখিও সাদা, শুধু তাই নয়, এখানকার মানুষও সাদাটে। ভারতবর্ষের উত্তরাংশের একটু নিচে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা অঞ্চলের মানুষ, মাটি, পশুপাখি গেরুয়া রংয়ের। ভারতের দক্ষিণে (তামিলনাড়ু কর্ণাটক অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, শ্রীলংকা) দেখা যায়-এই সব অঞ্চলের মাটি, মানুষ এবং পশুপাখি সবই কালো। সার্বিকভাবে বলা যায় মূল রং ও প্রকৃতির সাথে ভারতবর্ষের প্রকৃতির মিল রয়েছে বলে এর নাম ভারত। এজন্য ভারতবর্ষ আল্লাহর বিশেষ রহমত ও কৃপার স্থান। সেটি হোক বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা নেপাল।
ভারতবর্ষ আল্লাহর বিশেষ রহমতের স্থান বলার আরো একটি কারণ রয়েছে। ইতিহাস বলে -লন্ডন, আমেরিকা, কানাডার মতো দেশ তের হাজার বছর পর পর বরফের নিচে তলিয়ে যায়। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল হিসেবে জানা যায়- পৃথিবী প্রতি সেকেন্ডে ২৯.৭৮ কি.মি. গতিতে ঘূর্ণমান। পৃথিবীর ঘূর্ণন অনেকটা লাটিমের মতো। লাটিম ঘূর্ণনের শেষ পর্যায়ে যেরকম আচরণ করে পৃথিবীর ঘূর্ণনটাও অনেকটা সেই রকম।একটা ঘূর্ণন দিতে পৃথিবীর ছাব্বিশ হাজার বছর সময় লাগে। ঘূর্ণনের সময় সূর্যের নিকটবর্তী হলে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক বৈশ্বিক উষ্ণতা শুরু হয় এবং এর সময়কাল তের হাজার বছর। তের হাজার বছর পর যখন পৃথিবী সূর্য থেকে বিপরীতে যায় তখন পৃথিবীতে প্রাকৃতিক হিমবাহ শুরু হয়। এর স্থায়িত্বকালও তের হাজার বছর। দুইয়ে মিলে ছাব্বিশ হাজার বছর।
এগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই হয়, মানুষের কোনো হাত নেই। এখনকার সময় থেকে আরো এগারো হাজার আটশত বছর পূর্বে প্রাকৃতিক হিমবাহ শেষ হয়েছে। সেই সময় গ্রেট ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডন দশ হাজার ফুট, নিউইয়র্ক শহর পচিঁশ হাজার ফুট বরফের নিচে নিমজ্জিত ছিল। এটি এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতেও উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতার ১০২০বছর চলছে। পুনরায় যখন প্রাকৃতিক হিমবাহ শুরু হবে এই সব দেশসমূহ বরফের নিচে যাবে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত।
কিন্তু আল্লাহর কী অপরিসীম কৃপা এই অঞ্চলের দেশসমূহ প্রাকৃতিকভাবে এমন আবারণে আবৃত যে-উষ্ণতা ও হিমবাহের সময় এর প্রাকৃতিক পারিবেশের কোনোরূপ পরিবর্তন পূর্বেও ঘটেনি, ভবিষ্যতেও পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, যদি আমরা প্রকৃতির দূষণ না করি। এর কারণ হলো – ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা, পূর্ব ও দক্ষিণে পূর্বঘাট, পশ্চিম ও দক্ষিণে পশ্চিমঘাট এবং পশ্চিমের নিচে নীলগিরি পর্বতমালা অবস্থিত। পূর্বঘাট ভারতের পূর্ব উপকূল জুড়ে অসমভাবে বিস্তৃত পার্বত্য এলাকার নাম। এটি উড়িষ্যা থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ,তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ভারতের পশ্চিম ভাগে প্রসারিত একটি পর্বত শ্রেণী। এটি মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটক, কেরালা ও তামিলনাডুর মধ্যে দিয়ে ১৬০০ কি.মি. বিস্তৃত পর্বতমালা কন্যাকুমারী শহরের নিকটে ভারতের দক্ষিণ বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। হিমালয় পর্বত মালা ভারতের উত্তর সীমান্তে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ কে মধ্য এশিয়া থেকে আসা হিম প্রবাহকে প্রতিহতসহ হিমালয়ের বরফ গলে উত্তর ভারতের নদীগুলোতে পতিত হয়।
ফলে এই উপমহাদেশে প্রাকৃতিক হিমবাহের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো বরফে তলিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অপরদিকে হিমালয় পর্বতমালা পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে। সবকিছু বিবেচনা করে ভারতবর্ষকে প্রকৃতি তথা হিমালয়ের দান বলে। এর প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে প্রাকৃতিক হিমবাহ ও বৈশ্বিক উষ্ণতার সময়ে পশ্চিমাদেশসমুহের মতো অবস্থা হওয়ার তেমন একটা সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ ভারতবর্ষ বরফে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার বরফ গলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি হলেও পূর্ব- পশ্চিমঘাট ও নীলগিরি পর্বত সংরক্ষণ করবে। ফলে বাংলাদেশও সুরক্ষিত থাকবে।
এইজন্য প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরিবর্তিত রয়েছে। আল্লাহর বিশেষ রহমতে পরিপূর্ণ বলেই প্রাচীনকাল থেকে এই অঞ্চল আধ্যাত্মিক মুনি -ঋষি, আওলিয়ার বিচরণ স্থল। প্রকৃতিকতা ও আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর বলে এই অঞ্চলে অন্যান্য দেশ থেকেও সাধকগণ জ্ঞান অর্জন করার জন্য এসেছেন। তাই এর সংস্কৃতি, জ্ঞান ও দর্শনে প্রাকৃতিকতায় পরিপূর্ণ। অন্যান্য দেশে দুটি ঋতু হলেও ভারতবর্ষে ছয়টি ঋতু। এটি এই অঞ্চলের সৌন্দর্য। আধ্যাত্মিক জ্ঞান চর্চার জন্য উপযুক্ত স্থান বলেই এর নাম ভারত। তাই এই অঞ্চল অগণিত সাধকের বিচরণ স্থল। উল্লেখযোগ্য কয়েকজন সাধক ও আউলিয়া বিশেষ করে হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ (ক) মাইজভাণ্ডারী, হযরত মওলানা মতিয়র রহমান শাহ (ক) ফরহাদাবাদী, হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক (ক) মাইজভাণ্ডারীর জীবনী আলোকপাত করলে দেখি সকলেই প্রকৃতির প্রধান উপাদান পঞ্চতত্ত্বে (আকাশ, অগ্নি, বায়ু,পানি ও মাটি) সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টায়ত্ত অর্জন করেছেন।
প্রাকৃতিকতা ধারণ করেছেন বলেই তাঁদের প্রতিটি কাজে প্রকৃতির গুণ খুঁজে পাওয়া যায়। তাই এঁরা প্রকৃতির মতো নিরব ও উদার। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতির মতো মানুষকে অকাতরে দয়া বিতরণ করেছেন, বিনিময়ে কিছু চায়নি। শুধু চায় প্রকৃতির মতো নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। প্রকৃতি প্রেম ব্যতীত স্রষ্টাপ্রেমি হওয়া যায় না। সৃষ্টির প্রতিটি কণায় স্রষ্টাকে অনুভব করতে না পারলে সে কখনো স্রষ্টার নৈকট্যতা অর্জন করতে পারে না। প্রকৃতির নীরবতার ভাষা যে বুঝে না, সে আল্লাহর ইশারা বুঝতে পারে না। তাদেঁর শিক্ষা গ্রহণ করলে কেউ অপ্রয়োজনে প্রকৃতির প্রাণ বৃক্ষনিধন করতে পারে না। আকাশ, পানি, বায়ু, মাটি, দূষণ করতে পারে না। কিন্তু যখন থেকে আউলিয়াদের জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছি, তখন থেকে আমাদের অধঃপতন শুরু হয়েছে এবং প্রকৃতির দূষণ ও শোষণ করা শুরু করেছি। যে ব্যক্তি বা জাতি নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জ্ঞানকে ভুলে যায় তার পতন অবধারিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক