প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানুষের কাঠের চাহিদা লাঘবে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির ভূমিকা

ড. মোঃ আবুল কাসেম | বৃহস্পতিবার , ২৮ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

বিভিন্ন উদ্ভিদ আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে। যেমন খাদ্য উদ্ভিদ, ঔষধী উদ্ভিদ, বস্ত্র তৈরীর উদ্ভিদ, জ্বালানি উদ্ভিদ, অলঙ্কার বা শোভাবর্ধক উদ্ভিদ এবং অন্যান্য ব্যবহার্য উদ্ভিদ। সব উদ্ভিদই মাটি থেকে পানি ও পুষ্টি শোষণ করে থাকে। তাদের মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল হাইব্রিড উদ্ভিদগুলোর পুষ্টি ও পানির চাহিদা দেশীয় উদ্ভিদগুলোর তুলনায় বেশি। উদাহরণস্বরূপ দেশি মুরগি ও দেশি গরুর তুলনায় বয়লার মুরগি ও অস্ট্রেলিয়ান গরুর পুষ্টির চাহিদা অনেক বেশি। দেশের মানুষের মাংসের চাহিদা মেটাবার জন্য তাদের চাষাবাদ দিন দিন বাড়ছে।

ঠিক তেমনি ভাবে কাঠের চাহিদা মেটাতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির আগমন ঘটে বাংলাদেশে। প্রথম ১৯৩০ সালে সিলেটের চা বাগানের সৌন্দর্য বাড়াতে ইউক্যালিপটাস আনা হয়, যা যা ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ষাটের দশক থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত গবেষণা করে দেশের সব কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের উপযোগী অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত ৮০০ জাতের ইউক্যালিপটাস থেকে মাত্র ৩ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস এবং ৮ জাতের আকাশমণি থেকে মাত্র ২ প্রজাতির আকাশমণি গাছ অবমুক্ত করেন।

জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ইউক্যালিপটাসের প্রথম বনায়ন শুরু হয় পর্তুগালে প্রায় ৪০০ বছর আগে, তারপরে ব্যাপকভাবে এর বনায়ন শুরু হয় ব্রাজিলে। বর্তমান বিশ্বে এর বনায়নের পরিমাণ ১ কোটি ৩০ লাখ হেক্টর। বাংলাদেশেও ১৯৬০ সালের পরে প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর উপকূলীয় অঞ্চলে বনজ সম্পদ সৃষ্টি করা হয়।

): ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির সুবিধা সমূহ:

ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি উদ্ভিদ সমূহ দ্রুত বাড়ে, পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা বেশি, যে সমস্ত অবক্ষয়িত জায়গায় অন্য কোন গাছ জন্মানো সম্ভব না, সেই সমস্ত জায়গায়ও এদের চাষ করা যাচ্ছে। উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে, পতিত জমিতে, রাস্তার ধারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বাড়ির আঙিনায় ও শুষ্ক মাটিতে, জলাশয়ের আশেপাশে ও অবক্ষয়িত বনে এদের রোপণ করা যেতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলে এদের চাষে মানুষের কাঠের চাহিদা, ঘরের খুঁটি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংস থেকে মানুষের ধন সম্পদ রক্ষা, মাটিকে চাষ উপযোগী ও ভূমির ক্ষয় রোধে গাছগুলো কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। ইউক্যালিপটাস গাছ শুধু কাঠই প্রদান করে না, তারা পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, চারিপাশে সুগন্ধ ছড়ায়, এবং এই গাছের তেল নানা রকম ঔষধি ও প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, আকাশমণি গাছের কাঠ বেশ মূল্যবান এবং বিভিন্ন নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয় এবং উক্ত গাছের পাতা মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে মাটিকে সমৃদ্ধ করে তোলে (তথ্য: বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম)

মাটির গুণাগুণ, আবহাওয়া, রোপণের ঘনত্ব ও পরিচর্যার উপর ভিত্তি করে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ যথাক্রমে ৫১০ বছর এবং ৫৭ বছরের মধ্যে কাঠ প্রদানের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। সেগুন ব্যবহার উপযোগী কাঠ উৎপাদন করতে সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর সময় নেয়।

বাংলাদেশে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি বছরে হেক্টর প্রতি ১০ ঘনমিটার অন্যদিকে দেশীয় গাছগুলো ২.৫ ঘন মিটার কাঠ দিয়ে থাকে। তুলনামূলকভাবে ইউক্যালিপটাস দ্রুত বর্ধনশীল গাছ এবং ক্ষেত্র বিশেষে বছরে ১ মিটারের বেশি বৃদ্ধি পায়।

কাঠের বাড়তি চাহিদা মেটাতে এদের বিকল্প নাই। বন অধিদপ্তর বলছেন, বাংলাদেশের প্রতিবছর কাঠের চাহিদা ৮০ লাখ ঘনফুট, মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয় ৩০ লাখ ঘনফুট। বাকি কাঠের চাহিদা দেশীয় উৎস থেকেই মেটানো হচ্ছে, তাতে অবশ্যই ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বয়স্ক সাধারণ বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে, ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে, গ্রীষ্মের দুপরে কমপক্ষে ১০০ গ্যালন পানি বাতাসে নির্গত করে পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে, পানিচক্র নিয়ন্ত্রণে ও অধিক বৃষ্টিপাত ঘটাতে ভূমিকা রাখে এবং বছরে প্রায় ১০ থেকে ৪০ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশ রক্ষায় ও মানব সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া তারা আল্লাহ তাআলাকেও সেজদা করে (আর রহমান:)। ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি নিশ্চয়ই অন্যান্য উদ্ভিদের মতো উপরোক্ত সেবা সমূহও প্রদান করে থাকে।

) পানিশোষণ, কাঠ উৎপাদন ও ক্ষতিকর প্রভাব:

ইউক্যালিপটাস গাছ দিনে প্রায় ২০২০০ লিটার পর্যন্ত পানি টেনে নেয় (আকাশমনি কিছু কম শোষণ করে)। অন্যদিকে দেশীয় ফলদ ও বনজ গাছ দৈনিক গড়ে ২০৭০ লিটার পানি শোষণ করে থাকে। দেশীয় গাছের মধ্যে সাদা কড়ই ইউক্যালিপটাসের চেয়ে বেশি পানি শোষণ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্টি এন্ড এনভারমেন্ট সায়েন্সের গবেষণা অনুযায়ী, এক ঘন সেন্টিমিটার কাঠ উৎপাদনে কদম গাছ পানি শোষণ ৪,২৩৩ মিলিমিটার, ইউক্যালিপটাসের ক্যামেলডালেন্সিস প্রজাতি শোষণ করে ৩,১৪৫ মিলিমিটার, আকাশমণি (একাশিয়া) শোষণ করে ২,২২৩ মিলিমিটার (অধ্যাপক ডঃ কামাল হোসেন)

সাধারণত হাইব্রিড জাতের সকল উদ্ভিদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য অতিরিক্ত পুষ্টি ও পানির প্রয়োজন হয়। যেমন বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে ৩,৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ পানির উৎস থেকে। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন, বৃক্ষচ্ছেদন, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট, এবং ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জের অভাব। শুধু ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে, যা দিয়ে মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আকারের অন্তত ২০টি স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব।

সম্প্রতি ব্রিটিশ সাপ্তাহিক নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে কূপ থেকে লাখ লাখ লিটার পানি উত্তোলনের ফলে অনেক স্থানে দ্রুত কমে গিয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ। গবেষকরা মূলত জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের অতিরিক্ত পানি ব্যবহারকে এর জন্য দায়ী করেছেন। উল্লেখ্য যে, ইউক্যালিপটাস বা আকাশমণি গাছের পানি শোষণের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামা বা কৃষি জমির আদ্রতা কমে যাওয়ার তথ্য আমার জানামতে কোন গবেষণায় উপস্থাপন করা হয় নাই। সাধারণত মাটি মৃত বা জীবিত উভয় অবস্থায় থাকে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহতালা আল কুরআনে (ইয়াসিন: ৩৩) উল্লেখ করেছেন যে, আমি বৃষ্টির পানি দ্বারা মৃত ভূমিকে জীবিত করি এবং তা থেকে ফসল বাহির করে আনি। বছরের কোন এক সময়ে মাটি শুষ্ক হয়ে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এর জন্য কোন উদ্ভিদকে এককভাবে দায়ী করা ঠিক না।

) পরিবেশে সেগুন গাছের প্রভাব : যে অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৫ই মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন১ অধিশাখা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ দুটির চারা তৈরি, রোপণ ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছেন, আমার অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, এই উদ্যোগ সেগুনের ক্ষেত্রে হলে প্রশংসনীয় হতো। কারণ উল্লেখিত দুইটি উদ্ভিদের চেয়ে পরিবেশে সেগুনের নেতিবাচক প্রভাব অনেক অনেক গুণ বেশি।

পর্যবেক্ষণকারীদের মতে, সেগুন গাছের শিকড় খুব বেশি গভীরে পৌঁছায় না, ১ থেকে ২ মিটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে মাটি থেকে পানি শোষণ করে মাটিকে রুক্ষ করে তোলে। ফলে যেখানে সেগুন গাছ লাগানো হয়, সেখানে মাটি শুকিয়ে যেতে থাকে। পাহাড়ি অঞ্চলের ঝিরিঝর্ণা, যা প্রাকৃতিক পানির উৎস, সেগুন গাছের কারণেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এই গাছের পাতাগুলি বেশ বড় এবং মাটিতে পড়ে মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধি করে যা মাটির পুষ্টি চক্রকে ব্যাহত করে।

সেগুন গাছের পাতা অনেক বড়, এ গাছের ছায়ায় অন্যান্য গাছপালা জন্মাতে পারে না বা তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং জীববৈচিত্র্য কমে যায়। তাছাড়া এ গাছের শিকড় মাটি আলগা করে দেয় এবং ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত করে।

এই প্রসঙ্গে সেগুন গাছ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশে বিরূপ প্রভাব শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাহাড়ে পরিবেশের বিষবৃক্ষ হলো সেগুন। সেগুন গাছ লাগানোর ফলে পরিবেশে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, তা স্থানীয় জনগণের জীবিকা এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রার জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

যাই হোক, যে সমস্ত অজুহাতের ভিত্তিতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ রোপণ নিষিদ্ধ করেছেন তাদের কোন বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন ছিল। গত ৮৫ বছর যাবৎ যে উদ্ভিদ দুটোর চাষাবাদ করা হচ্ছে, এবং যাদেরকে বাংলাদেশ বনবিভাগ একটানা ১০ বছর গবেষণা করে অবমুক্ত করেছেন, তাদেরকে অনুমানের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ না করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ও ফরেস্ট্রি এন্ড এনভারমেন্ট, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল, ভূগর্ভস্থ পানি বিজ্ঞান দপ্তর, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক, আইডব্লিউএম এর নির্বাহী পরিচালকদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে দেশের মঙ্গল হতো।

আমি বলছি না যে, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির কোন বিরূপ প্রভাব পরিবেশের উপর নেই কিন্তু তাদের চাষাবাদ বন্ধ না করে ব্যবহারে একটা সীমারেখা টানা যেতে পারে। যেমন প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, একক বাগান ও ফসলি জমির পরিবর্তে উপকূলীয় অঞ্চল, অবক্ষয়িত বন পতিত জমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি অফিস প্রাঙ্গণ ও জলাভূমির আশেপাশে এই বৃক্ষসমূহ রোপণ করা যেতে পারে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানুষের কাঠের চাহিদা লাঘবে গাছ দুটো ভূমিকা রাখবে। আমার এই দৃষ্টতা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে সংশ্লিষ্ট মহলকে এ ব্যাপারে পুনঃ বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক: অধ্যাপক, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম
পরবর্তী নিবন্ধমেয়ের চোখে বাবা প্রফেসর এল এ কাদেরী