প্রায় ৪০ টন ওজনের একটি কন্টেনারসহ পুরো লরির নিচে চাপা পড়েও যাত্রীবাহী একটি প্রাইভেট কারের পাঁচ আরোহীর সবাই সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। রক্ত হিম করে দেয়া ঘটনায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তারা কন্টেনারের নিচে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়া প্রাইভেট কারের ভিতর আটকা ছিলেন। এ ঘটনায় ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় তিন ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। তুমুল বৃষ্টির মাঝে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ এবং স্থানীয় উদ্ধারকারীরা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া প্রাইভেট কারের ভিতর থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করেন। এদের মাঝে দুইজন শিশুকন্যাও ছিল।
পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের মোহাম্মদ মুছা গতকাল দুবাই ফেরত মেয়ের জামাতা আবু বকর এবং দুই নাতনি আদিবা এবং আদিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ফটিকছড়ি ফিরছিলেন। ভাড়া করা টয়োটা ফিল্ডার মডেলের গাড়ি (চট্টমেট্রো–গ–১১–৮৭৩৩) নিয়ে তারা বিমানবন্দর থেকে পতেঙ্গা–ফৌজদারহাট আউটার রিং রোড ধরে ফৌজদারহাটে পৌঁছে। তাদের ইচ্ছে ছিল ভাটিয়ারী বাজার হয়ে গলফ ক্লাবের রোড ধরে হাটহাজারী সড়কের বড়দীঘির পাড় পৌঁছে ফটিকছড়ি যাবেন। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ গাড়িটি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ পার হয়ে বাংলাবাজারের কিছুটা আগে পৌঁছালে ৪০ টনের কন্টেনার নিয়ে ঢাকাগামী একটি লরি আচমকা উল্টে গিয়ে প্রাইভেট কারটিকে চাপা দেয়। এতে কন্টেনারসহ পুরো লরিটি প্রাইভেটকারের উপর চড়ে বসে। পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রের দাবি, প্রাইভেট কার এবং কন্টেনারবাহী লরি দুই গাড়িই প্রচণ্ড গতিতে ছিল। একটি অপরটিকে ওভারটেক করার সময় আইল্যান্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কন্টেনারসহ লরিটি উল্টে যায় এবং প্রাইভেট কারটিকে চাপা দেয়। অপর একটি সূত্র বলেছে, একজন স্কুলছাত্র রাস্তা পার হওয়ার জন্য হঠাৎ দৌড় দিলে প্রাইভেটকারটির চালক কড়া ব্রেক করে। এই সময় পেছনে থাকা কন্টেনারবাহী লরিটিও কড়া ব্রেক করলে সেটি উল্টে যায় এবং প্রাইভেটকারকে চাপা দেয়। কন্টেনার চাপায় কারটি পুরোপুরি চ্যাপ্টা হয়ে যায়।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বার আউলিয়া হাইওয়ে পুলিশ ও ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির পৃথক দুইটি দল ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় তারা আটকা পড়া যাত্রীদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা চায়। পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের দীর্ঘ চেষ্টার ফলে প্রায় দুই ঘণ্টা পর যাত্রীদের সকলকে জীবিত এবং অনেকটা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
দুর্ঘটনায় আহতরা হলেন প্রবাসী আবু বক্কর (৪২), বিমান বন্দরে তাকে নিতে আসা তার শ্বশুর মুছা আহম্মদ (৬৩), আবু বকরের মেয়ে আবিদা আক্তার (৬), আদিলা আক্তার (২) ও প্রাইভেটকারের চালক মোহাম্মদ বেলাল (৩২)।
দুর্ঘটনার পর আদিবা গাড়ির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এই সময় অপর একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়ার উপক্রম হয়। স্থানীয় উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত শিশুটিকে উদ্ধার করে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়। ভিতরে চারজন আটকা পড়ে থাকে। তাদের চিৎকার এবং কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন যানবাহনের শত শত মানুষ উদ্ধারকারীদের সঙ্গে ভিড় করতে থাকে। কন্টেনারের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে থাকা গাড়ির ভিতর থেকে বয়স্ক মানুষের কান্না ও বাঁচানোর আকুতির পাশাপাশি শিশুর কান্নাও ভেসে আসতে থাকে।
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা রেকার এবং শক্তিশালী ক্রেন এনে কন্টেনারটি আলগা করে ভিতর থেকে কৌশলে গাড়িটি বের করে আনে। গাড়ির ছাদ কেটে যাত্রীদের বের করে আনা হয়। তবে এই সময় যাত্রীদের প্রায় সকলকেই অনেকটা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ফ্রন্ট সিটে থাকা মোহাম্মদ মুছা এবং ড্রাইভার বেলাল কিছুটা আহত হয়। তবে তাদের মনের উপর দিয়ে বিরাট এক ধকল যাওয়ায় সকলেই ট্রমার মধ্যে রয়েছে বলেও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
দুর্ঘটনার কারণে প্রায় তিন ঘণ্টা ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঢাকামুখী যান চলাচল বন্ধ থাকে। এই সময় চট্টগ্রাম শহর থেকে ছেড়ে যাওয়া অসংখ্য গাড়ির পাশাপাশি টোল রোড ধরে বন্দর থেকে আসা শত শত পণ্যবাহী গাড়ি আটকা পড়ে। দীর্ঘক্ষণ যান চলাচল বন্ধ থাকায় বহু মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলেও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের উপ–পরিচালক ফিরোজ আলম জানান, আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি লরিটি উল্টে প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে আছে। পরে লরিটি অপসারণ করে প্রাইভেটকারের পাঁচ যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়। লরিটি কিছুটা আস্তে পড়ায় আল্লাহর রহমতে যাত্রীরা বেঁচে গেছেন। তবে যাত্রীরা মাথায় সামান্য আঘাত পাওয়া এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় সবাইকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বার আউলিয়া হাইওয়ে পুলিশের ইনচার্জ বেলাল হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুততার সঙ্গে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করি। পরবর্তীতে ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির দুটি ক্রেনের সাহায্যে লরিটিকে উপর দিকে সরিয়ে প্রাইভেট কারটি বের করা হয়। দুর্ঘটনায় প্রাইভেটকার চালক সামান্য আহত হলেও বাকিরা মোটামুটি অক্ষত ছিল। পাঁচ যাত্রীর মধ্যে ২টি ছোট শিশুও ছিল। যাত্রীরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করায় তাদের জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ৪০ টন ওজনের কন্টেনার প্রাইভেট কারের ওপর চাপা পড়েছিল। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্রেন দিয়ে কন্টেনার সরিয়ে প্রাইভেট কারে থাকা চালকসহ সব যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়। তারা সামান্য আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, কন্টেনারের চাপায় থাকা প্রাইভেট কারের অবস্থা দেখে তারা ধারণা করেন, একজন মানুষও সেখানে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। তারা উদ্ধারকাজ কীভাবে করবেন, সে রকম একটা পরিকল্পনা করছিলেন। পুলিশের রেকার প্রায় ৪০ টন ওজনের কন্টেনারকে তুলে ধরার ক্ষমতা ছিল না। পরে তিনি পরিকল্পনা করেন কন্টেনারের এক প্রান্ত রেকার দিয়ে তুলে ধরবেন, যাতে চাপা পড়ে থাকা গাড়িটি থেকে আটকে পড়াদের বের করে আনা যায়। কিন্তু সেখানেও ঝুঁকি রয়েছে। যদি কোনো কারণে রেকারের লোহার রশি ছিঁড়ে যায়, তাহলে আর আটকা পড়াদের জীবিত উদ্ধার করা যাবে না। কিন্তু তাৎক্ষণিক এরকম পরিকল্পনা করা ছাড়া তার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশকে দ্রুত বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে কন্টেনারের যে অংশে কারটি চাপা ছিল, সে অংশটি রেকার দিয়ে টেনে ওপরের দিকে তুলে ধরেন তারা। বড় বড় কাঠের গুঁড়ি দিয়ে কন্টেনার ঠেকা দেন। কন্টেনারটি যখন উঁচু করে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে আটকে রাখা হলো, তখন কারের ভেতরে থাকা যাত্রীদের সবাই জীবিত আছেন বলে নিশ্চিত হন তারা। এরপর তারা আর ঝুঁকি নিতে চাননি। বড় ক্রেনের অপেক্ষা করছিলেন। ১৫ মিনিট পর বড় ক্রেন নিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে কন্টেনারের যে অংশ আগে থেকে তোলা ছিল, সে অংশকে ক্রেন দিয়ে টেনে ধরেন এবং রেকার ভ্যান দিয়ে প্রাইভেট কারটি টেনে বের করে আনেন। এরপর একে একে চার আরোহী ও চালককে জীবিত উদ্ধার করেন তারা। যখন একে একে প্রাইভেটকারে আটকাপড়া যাত্রীদের বের করা হচ্ছে তখন উদ্ধারকারীরা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে খুশিতে আত্মহারা। উপস্থিত লোকজন হাততালি দিয়ে উদ্ধারকারীদের অভিনন্দন জানায় আর বলতে থাকে– ‘রাখে আল্লাহ মারে কে!’
দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেট কার ও লরি জব্দ করা হয়েছে। উভয় গাড়ির চালককে আসামি করে হাইওয়ে পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা রেকর্ড করেছে।