মেডিকেল শিক্ষা একটি জটিল শিক্ষা ব্যবস্থা। এতে তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরও কঠোর পরিশ্রম ছাড়া পাস করা কঠিন। সাথে থাকতে হয় প্রচুর ব্যবহারিক ও ক্লিনিক্যাল জ্ঞান। আর সেই জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অধীনে অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ। কিন্তু দেশের প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোতে রয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব ও ক্লিনিক্যাল সুযোগ সুবিধার অপর্যাপ্ততা।
অথচ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন ২০২২ অনুযায়ী, প্রতিটি কলেজের জন্য দরকার দুই একর জমি। প্রতি ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য দরকার কলেজে এক লাখ বর্গফুট ও হাসপাতালের জন্য দরকার এক লাখ বর্গফুট আয়তনের মেঝে। শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শেখার জন্য কলেজের হাসপাতালে কমপক্ষে ২৫০টি শয্যা ও ১৭৫টি শয্যায় নিয়মিত রোগী থাকা দরকার। কিন্তু অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সেই পরিমাণ জমি ও শয্যার হাসপাতাল নেই। বর্তমানে দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৭৭টি। এর মধ্যে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ছয়টি কলেজকে ২০২২–২৩ শিক্ষাবর্ষ হতে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ চালু, শিক্ষা দান ও পরীক্ষা এবং নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের দরকার হয়। ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একটিরও এইসব অনুমোদন নেই।
মেডিকেলে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার গুরুত্ব সমান। হাতেকলমে শেখার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এর জন্য শিক্ষার্থীদের তৃতীয় বর্ষ থেকেই রোগীর মুখোমুখি হতে হয়, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রোগীর পাশে থেকে শিখতে হয়। কিন্তু বেশ কিছু বেসরকারি মেডিকেলে হাতেকলমে শেখার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক রোগী থাকে না। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন ৪০% বেসরকারি মেডিকেলে এই সমস্যা রয়েছে। পাঁচ বছরের শিক্ষা কার্যক্রমের শেষ সাড়ে তিন বছর মূলত ব্যবহারিক শিক্ষা। হাসপাতালে রোগী না থাকলে এই শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না। দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী চিকিৎসক হতে গেলে রোগীর কাছে থেকেই শিখতে হয়। মেডিকেল শিক্ষায় সাধারণ ক্লাসের পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিন পরীক্ষা থাকে। শিক্ষণ ও ব্যবহারিক শিক্ষা হতে হয় নিবিড়ভাবে। এজন্য পর্যাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের অনুপাত নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক থাকতে হয়। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষকের সংখ্যা কী হবে, তাও বলা আছে। তবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী অনুমোদিত ৭৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৬টিতে অ্যানাটমির কোনো অধ্যাপক নেই, ১৬টিতে ফিজিওলজির অধ্যাপক নেই, ১৭টিতে বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক নেই, ১৮টিতে ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক নেই। আবার কোনো কোনো কলেজে একই বিষয়ে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এমনকি সহকারী অধ্যাপকও নেই। সেসব কলেজ চালানো হচ্ছে প্রভাষক দিয়ে। বর্তমানে সরকারি মেডিকেলের শিক্ষকদের বয়সসীমা ৬০ বছর আর বেসরকারি মেডিকেলে ৬৫ বছর। বয়সের কারণে সরকারি মেডিকেলে যাঁদের যোগ্য বলে বিবেচনা করা হচ্ছে না, তাঁরা যোগ দিচ্ছেন বেসরকারি মেডিকেলে। ফলে অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক পদে আছেন সরকারি মেডিকেল কলেজ বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যাওয়া চিকিৎসক কর্মকর্তারা।
জানা যায়, ২০২৩–২৪ শিক্ষাবর্ষে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন আছে ৬,৭৭২টি। ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ সব আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি হলে কলেজগুলোর আয় হবে ১,৩৫৪ কোটি টাকা। তবে ভর্তি থেকে প্রকৃত আয়ের পরিমাণ আরো বেশি। কারণ সব কলেজ মিলে মোট ২,৫০০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমোদন আছে, তাঁদের ফি দেশি শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি।
এদিকে যুক্তরাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০১৬ সালে নতুন প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল। তাতে সরকারি মেডিকেলের পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেলের নানা ত্রুটিও ধরা পড়ে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো এক নিয়মে চলে না। কোনোটি লিমিটেড কোম্পানি, কোনোটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে চলে, কোনোটি চালায় ট্রাস্ট। কোনো কোনো কলেজের ভবন কলেজ চালানোর উপযুক্ত নয়। অনেকের মেডিকেল জার্নাল নেই। অনেকের প্রয়োজনীয় জায়গা নেই। অনেকের পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। গবেষণার শেষের দিকে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল– ১. মেডিকেল কলেজ পরিদর্শনের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানো ২. শিক্ষক স্বল্পতা দূর করার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৩. প্রতিষ্ঠার সব শর্ত পূরণ না হলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আর কোনো মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা না।
এদিকে এবছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো পড়েছে শিক্ষার্থীর সংকটে। ৫ জুন প্রথম বর্ষ এমবিবিএস ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বরাদ্দকৃত আসনের ১৯% শতাংশ বা ১,২০০ আসন খালি রয়েছে বলে জানা গেছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর আয়ের অন্যতম বড় উৎস শিক্ষার্থী ভর্তির অর্থ। কোনো কোনো কলেজ ভর্তি থেকে বছরে আয় করে ২০ কোটি টাকার বেশি। অভিযোগ আছে, ভর্তির ব্যাপারে কলেজগুলো যতটা মনোযোগী, শিক্ষার ব্যাপারে ততটা মনোযোগী না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেখা গেছে বেসরকারি মেডিকেল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা ক্লিনিক্যালী অনেক দুর্বল, তারা বিসিএসসহ ভালো কোনো চাকরি পায় না। তাই অনেকে চিকিৎসা পেশায় আসে না। উচ্চতর ডিগ্রি বা স্নাতকোত্তর পর্যায়েও তারা ভালো করে না। সেজন্য অভিভাবকেরা অনেক টাকা খরচ করে এখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সন্তানদের ভর্তি করাতে চাচ্ছেন না।
এদিকে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শেষ হওয়ার পর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়। সরকারি ও বেসরকারি কলেজে শিক্ষার্থীদের মেধাক্রম অনুসারে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। মেধাক্রমের ওপরের দিকে থাকা শিক্ষার্থীরা ভালো কলেজে ভর্তি হন। তবে যেসব মেডিকেল কলেজ সুনাম অর্জন করেছে। তাদের শিক্ষার্থীর সংকট নেই। সংকটে পড়েছে সেসব কলেজ, যাদের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই, নেই হাতেকলমে শিক্ষার ব্যবস্থা। মূলত এরাই শিক্ষার্থী পাচ্ছে না এবং ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষার্থী ভর্তিও করাতে পারছে না। কারণ এমবিবিএস ভর্তি প্রক্রিয়া এখন পুরোপুরি ডিজিটাল। কোনো মেধাক্রমের শিক্ষার্থী কোনো কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ও কোনো কলেজে ভর্তি হচ্ছে, তা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ জানতে পারে। ইতিপূর্বে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম হতে দেখা গেছে। ৭,০০০ মেধাক্রমে থাকা শিক্ষার্থীকে বাদ দিয়ে মেধাক্রমের ৭০,০০০ অবস্থানের শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানোর নজির আছে। তবে ভর্তি প্রক্রিয়া ডিজিটাল হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের হয়রানি, অনিয়ম ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পথ বন্ধ হয়েছে। তাই দেশের স্বাস্থ্য খাত ও মেডিকেল শিক্ষার মান ঠিক রাখার স্বার্থে এই নজরদারি কঠোরভাবে পালন করা উচিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট