সেইজ জার্নাল চব্বিশ সালের জুলাই মাসে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে, যাতে বর্তমানের প্রথম সারির দেশ থেকে শুরু করে প্রান্তিক গোষ্ঠীতে ধর্ষণ সংক্রান্ত বিবিধ বিষয়ে নারীর মতামত, ধর্ষণ পরবর্তী ভিক্টিমাইজেশনের অবস্থা কিংবা কেবল শারীরিক শ্লীলতাহানির জন্যে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট দায়ের করা অথবা এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে নারী কত ধরণের বাধার সম্মুখীন হন সে সংক্রান্ত একটি গবেষণা রয়েছে। উক্ত গবেষণায় দেখা যায়, যে–কোনো শ্রেণির, বয়সের নারীই অন্তত ৭০ ধরণের বেশি সমস্যার সম্মুখীন হন শুধু ধর্ষণ বিষয়ক অন্যায়ের প্রতিবাদ নিয়ে ভাবতেই।
শুধুই কি এমন? দেখা যায়, ধর্ষণে শিকার নারীদের মামলা না করতে বেশিরভাগ প্ররোচনা আসে তার কাছের পরিবারের সদস্য থেকে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা’র ২০২১ সালের রিপোর্ট মোতাবেক, বিশ্বের এক তৃতীয়াংশের বেশি নারী তার সম্পূর্ণ জীবনচক্রে অন্তত একবার শারীরিকভাবে যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছে তাদেরই কাছের কোনো সঙ্গী থেকে। উন্নত বিশ্বে ধর্ষণের শিকার নারীর ৩১% কেবল মামলা দায়ের করেন, নিম্ন আয়ের দেশে সে সংখ্যা খুবই নগন্য। এছাড়া চব্বিশ সালের রিপোর্ট অনুসারে প্রতি নয় ঘণ্টায় অন্তত একজন নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং বাংলাদেশে প্রতি এক লাখে ১০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকেন। আরো উদ্বেগের বিষয় গত দ’ুমাসে ৯৬ জনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এসবের ভেতর শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। তবে উন্নত বিশ্বে আমাদের জন্যে যে সোশ্যাল কনটেক্স দাঁড় করানো হচ্ছে তার বাইরে আমাদের দেশের প্রান্তিক নারীদের ধর্ষণ বিষয়ক সচেতনতার দশা কেমন?
প্রান্তিক গোষ্ঠীর নারীদের মাঝে দেখা যায়, যৌন হয়রানি বিষয়ক কথা বলা এক ধরণের ট্যাবো। এধরণের আলাপকে তাদের অনেকেই বেহায়াপনা হিসেবে দেখেন। এছাড়া যেকোনো প্রান্তিক ধর্ষণ ঘটনায় দেখা যায়, প্রথম দিককার ধর্ষকের ইঙ্গিত বা আচরণ কিংবা যৌন হয়রানির কথা ভুক্তভোগী তার পরিবারকে জানালেও, পরিবারের নারী সদস্য সামাজিক সম্মানের দায়ে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। নারী সদস্যের অনেকেই কেবল আড়াল করেন তা নয়, ভুক্তভোগীকে মৌখিক ভাষাতে ভিক্টিমাইজেশন করতেও দেখা যায়। তবে তথাকথিত ভারি গবেষণা নির্ভর এসব বক্তব্য আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ, স্বয়ং বাংলাদেশের জন্যে খুবই স্বাভাবিক, নিত্য। ফলত এই সকল বিষয়ে পূর্বে আলোকপাত করা হলেও কার্যকরী কোনো উদ্যোগ চোখে আসে না।
উন্নয়নের জন্যে যোগাযোগের অন্যতম উদ্দ্যেশ্যই থাকে সচেতনতা সৃষ্টি। এ ধারার যোগাযোগে চারটি পন্থা বেশ উল্লেখযোগ্য। বিসিসি (আচরণ পরিবর্তনগত যোগাযোগ), এসসিসি (সামাজিক পরিবর্তনগত যোগাযোগ), সোশ্যাল মোবিলাইজেশন, এডভোক্যাসি। এ চার পন্থার প্রথম পন্থায় দেখা যায় ব্যক্তিক আচরণ পরিবর্তনে কাজ করা হয়, এসসিসি পন্থায় সামাজিক, তৃতীয় পন্থায় প্রতিষ্ঠানের এবং শেষমেশ এ সংক্রান্ত আইন। ফলত আমাদের সমাজের উন্নয়নের জন্যে যে–সকল সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানই কাজ করেছে তাদের প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল কেবল প্রথম পন্থা নির্ভর। অর্থাৎ শুধুই ধর্ষণ বিষয়ক আলাপেই যদি যাই, দেখা যায় আজ বহুকাল ধরে কেবল নারীকে সচেতন করার জন্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পেইন হয়ে আসছে। বলা যায় ব্যক্তিক পর্যায়ে সচেতনতার কোনো শেষ নেই তবে কেবল প্রথম পন্থার সফলতার মাধ্যমেই ধর্ষণের মতো অপরাধ এড়ানো সম্ভব নয়। সমাজের এই কুৎসা থেকে উতরিয়ে, উন্নয়ন করতে হলে তার যোগাযোগের চার পন্থাই সঠিকভাবে প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নে যেতে হবে।
আমাদের দেশে নারীকে সচেতন করা যতটা সহজ ততটা কঠিন একাধিক পুরুষ এবং তার পরিবারকে শিক্ষা দেওয়া যে, ধর্ষণ অন্যায়। ফলে উন্নয়নের দ্বিতীয় পন্থা এখানে সম্পূর্ণ অকার্যকর। বরং বলা যায় ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারকে এক পলক বেশি শিক্ষা দেওয়া যায় তাদের করণীয় নিয়ে। এরপর সোশ্যাল মোবিলাইজেশনের কথাই যদি বলি, আমাদের সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো ভীষণ হুজুগে, তারাও সাধারণ অন্ধ জনগণের মন বুঝে চলে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক আচরণের পরিবর্তন খুব একটা দেখা যায় না। বস্তুত আমাদের এখানে উন্নয়নের উদ্দ্যেশে যোগাযোগের সকল পন্থা এবং সংজ্ঞাই দিনে দিনে পরিবর্তন হতে থাকে কেবল সোশ্যাল মোবিলাইজেশনে পোকা ধরার ফলে। যেমন বড় একটি গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়নে যেসকল প্রতিষ্ঠান সামাজিক উন্নয়নের উদ্দ্যেশে কাজ করছে তাদের উন্নয়ন এবং উন্নয়নের উদ্দেশ্যে যোগাযোগ উভয় সংজ্ঞাই দ্বৈত অর্থ বহন করে, তাদের দ্বারা শ্লীলতাহানি কিংবা ধর্ষণকে জায়েজ করতে সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৎপর যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে এখানে সোশ্যাল মোবিলাইজেশন খাটে না, খাটে না এর পরবর্তী কোনো এডভোকেসিও।
প্রান্তিক নারী গোষ্ঠীর ধর্ষণ বিষয়ক সচেতনতা বাড়ানোর বর্তমানে একটি শেষ পন্থা যা মূলত উন্নয়নের জন্যে যোগাযোগেরও শেষ পন্থা তা হলো এডভোকেসি। সহজ বাংলায় ওকালতি তবে ঘটকালী থেকে এর নিদারুণ পার্থক্য আছে। এখানে এডভোকেসি এই অর্থেই যে, আপনি সচেতন হলেন, সমাজ সচেতন হলো এবং প্রতিষ্ঠান তার দায় এড়ালো না কিন্তু ধর্ষক পুলসিরাত পার করতে পারে না যদি আইনের পিচঢালা পথ যথেষ্ট মজবুত হয়, এতে কোনো ফাঁক থাকে না এবং সর্বাধিক উন্নত সরঞ্জাম ব্যবহার হয়।
এক্ষেত্রে প্রান্তিক নারীর জন্যেই না কেবল নারী অধিকারের জন্যে বিশ্বব্যাপী এবং দেশীয় এডভোকেসির শেষ নেই। তাহলে সচেতন হতেই কেন নারীকে ৭০’র বেশি সিরাত পড়তে হয়? এত বেশি বাধা কেন তবে? এডভোকেসির অন্যতম শর্ত হলো এর প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতা। একে এত বেশি স্বচ্ছ হতে হবে যে, কোনোভাবেই যেন ধর্ষক পার পেয়ে না যায়। আরেকটু যদি বলি, আইনে আছে ধর্ষণের মামলায় তিনজন সাক্ষী প্রয়োজন, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ছাড়া কোনোভাবেই মামলা নেওয়া যাবে না, ধর্ষণের শিকার নারীকে সামাজিক মর্যাদা রক্ষার্থে ধর্ষকের সাথে বিয়ে কিংবা নারীকে সুরক্ষা দিতে আধুনিক সান্ধ্য আইন ইত্যাদি… এমন অনেক বিষয়াদির জন্যে নারী ঠিক সচেতন হয়েও বাদবাকি স্টেজগুলো আর পার করতে পারেন না। পারেন না নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার চাইতে।
তবে প্রান্তিক নারী গোষ্ঠীর ধর্ষণ বিষয়ক সচেতনতার কি হবে? আমাদের সমাজে বোধ করি এখনো এমন কিছু মানুষ আছে যারা উন্নয়নের নামে মিথ্যা যোগাযোগ সেতু তৈরি না করে কেবল কাজটুকু করে যাবেন। কিভাবে করে যাবেন? এক্ষেত্রেও এডভোকেসির পন্থায় জোরদার করতে হবে আমাদের হাতিয়ার। এর মধ্যে প্রথমেই বলেছি আইনের স্বচ্ছতা নিয়ে, এরপর জরুরী আইনের প্রয়োগ, আইন রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল আচরণ, সরকারের সক্ষমতা বরং শেষ অব্দি আছে নাগরিক সচেতনতা।
আপাতত বলা যায়, উন্নয়নশীল যোগাযোগের সংজ্ঞা, পলিসি মেকিং এবং এর কার্যকর পদক্ষেপে প্রতিষ্ঠানকে কর্মতৎপরতা চালাতে হবে, প্রান্তিক ভৌগলিক সীমায় কেবল শহুরে সিস্টমকে স্টাবলিশ না করে, তাদের নিজস্ব সমস্যার উদ্ঘাটন করে তার সমাধান করতে হবে। কেননা উন্নত বিশ্বে প্রত্যেক নাগরিকের আচরণগত পরিবর্তনের জন্যে যে যোগাযোগ করা হচ্ছে সেখানে বাদবাকি তিন পন্থাকে আগে মজবুত ভিত্তি দেওয়া হয়েছে এবং তার ফলেই তাদের ব্যক্তিক পর্যায়ে কর্ম সম্পাদন সহজ হয়েছে। নারীর মুক্তির উদ্দেশ্যেই যেন সেসকল উন্নয়নশীল যোগাযোগ সংস্থাগুলো তাদের এজেন্ডা সেটিং করে থাকে সেটিও বিশেষ নজরে আনা প্রয়োজন। সর্বপোরি, নারীর একক উদ্যোগ, সচেতনতাও ততোধিক কাম্য।