আমরা সাধারণত কোনো বাচ্চা বা ছেলে–মেয়েকে যখন দেখি দুষ্টুমি করতে বেয়াদবি করতে অন্যায় করতে; ঢট করে বলে থাকি –এদের মা–বাবা এদেরকে শিক্ষা দেয়নি কিংবা এও বলে থাকি– যেমন মা বাবা তেমনি তার সন্তান। অনেকে আবার বলেই ফেলে, ‘আলেমের ঘরে জালেম’ । কাউকে এভাবেও মন্তব্য করতে শোনা যায়, এদের আচরণ দেখলে বোঝা যায় এরা কোন ফ্যামিলি থেকে এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে আমরা আদৌ জানি না বাচ্চা বা সন্তানের বাবা মা কেমন।
আমাদের সমাজে অনেকের স্বভাব রয়েছে অনুমান বা ধারণা করে কথা বলা। হোক সেটা সত্যি কিংবা মিথ্যে। কোনো কিছু সম্পূর্ণ না–বুঝে না–জেনে হুট করে মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া। কোনো কোনো বাচ্চা খুব দুষ্টু হতেও পারে, তার মানে এই নয় যে, ওর মা–বাবা খারাপ। সব বাবা–মা তার সন্তানকে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ধর্ম আদর্শ সংস্কার নৈতিকতা– এসব শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কেউ বেশি কঠোর কেউবা নমনীয়। কিন্তু এসব শিক্ষা সব বাচ্চার মনে সমান রেখাপাত করে না অর্থাৎ সব বাচ্চা সুশীল ভদ্র আদর্শবান হয়ে ওঠে না। এই অপরাধটা পুরোপুরি মা–বাবাকে দিলে অন্যায় হবে। বাচ্চারা বখে যায় সঙ্গদোষে অথবা পরিবেশের কারণে তবে তার মানে এই নয় যে মা–বাবা শিক্ষা দেয়নি। আমি দেখেছি অনেক শিক্ষাগুরু কিংবা শিক্ষানুরাগীর সন্তান পড়ালেখার ধারে কাছেও নেই।
আবার এও দেখা যায় অনেক স্বনামধন্য কলেজ ভার্সিটির অধ্যক্ষের কিংবা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের ছেলের নাম মাস্তানদের তালিকার শীর্ষে। উল্টো এমনও দেখেছি চাষার ঘরে ডাক্তার হয়ে সফলতা অর্জন করেছে। ঘরের পান্তাভাত খেয়ে মা–বাবার মুখোজ্জ্বল করেছে। সুতরাং সব মন্তব্য সবসময় সবক্ষেত্রে সবার ক্ষেত্রে যথার্থ নয়।
আগেকার দিনে প্রতিটি ঘরে ৫–১০টা করে বাচ্চা থাকতো। আমি এও দেখেছি এক নেতার ঘরে দুই বউয়ের ১৯টা বাচ্চা। তবে বাচ্চা জন্ম দেওয়াটা বড় কথা না বরং মানুষ করাটাই সবচেয়ে বড় কথা। মানুষ করতে পারলে বাজিমাত আর না পারলে কুপোকাত।
তুলনামূলকভাবে শিক্ষা দীক্ষায় এখনকার সময়ে বাচ্চা গড়ে তোলার চেয়ে আগেকার দিনে হয়তো আরো সহজ ছিল। তা না হলে এখন যে মা–বাবারা দুই একটা বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এই অবস্থা যদি তখন থাকতো তাহলে তো ওরা এতগুলো বাচ্চা নিত না। এখন আর তখন কতটা তফাৎ! একটু ভালো করে খেয়াল করলেই ব্যাপারটা সহজেই বুঝতে পারবেন। বড়দের সম্মান করা, ভদ্রতার সাথে কথা বলা, বড়দের দেখলে সমীহ করা, তফাতে চলা, প্রশ্নের জবাবে নমনীয়ভাবে কথা বলা– এসবই এখন কেবলই স্বপ্ন। কথায় কথায় চোখ তুলে জবাব দেওয়া বাড়াবাড়ি করা, পাল্টা দোষারোপ করা এখনকার ছেলেমেয়েদের স্টাইল। এখন একটা তৃতীয়/ চতুর্থ শ্রেণির ছেলেমেয়ের কথা শুনলেই মনে হয় যেন একজন ম্যাচিউরড মানুষ।
এরা এত বেপরোয়া এত ইচড়েপাকা কল্পনাই করা যায় না। দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এদের অন্যায় আবদার। ওরা বন্ধু–বান্ধব থেকেই বেশি অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এখানে মা–বাবার কথার তেমন কোনো পাত্তাই নেই।
তবে আরো আফসোসের বিষয় হচ্ছে কোনো ভাল বন্ধুর কাছ থেকে ভালো কোনো অভ্যেস বা আচরণ দেখে যতটা উৎসাহী না হয় তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি রপ্ত করে ফেলে ওদের বাজে অভ্যেসগুলো। বাইরে দেখে ঘরে তার প্রভাব বিস্তার করে মা বাবার ওপর। শুরু হয় আবদার তাণ্ডব তর্কাতর্কি বাড়াবাড়ি এমনকি অনশন। হয়তো বলে, ‘আমার ওই বন্ধু মোবাইল কিনেছে আমাকেও দাও’। কদিন পর বলে, ‘আমার ওই বন্ধুর কাছে আইফোন আছে আমার তো নেই’। আরো কদিন পর বলে, ‘অমুকের বাইক আছে আমারও দরকার’। একবারও বলে না যে, ‘আমার ওই বন্ধু খুব ভালো রেজাল্ট করে পুরস্কৃত হয়েছে আমাকেও হতে দাও’। এক সময় দেখবেন ওদের আবদার মেটাতে না পেরে তর্কে তর্কে হবে ভোর। মাথা ঘুরে উঠবে আপনার। চোখে মুখে অন্ধকার দেখবেন। মনে হবে আপনি আর পেরে উঠতে পারছেন না। এই বুঝি পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। আগে কোনো অভিভাবকের কাছে যখন ছেলেমেয়েদের অপরাধ ধরা পড়তো অপেক্ষাকৃত খারাপ কোনো কিছু হলে অভিভাবকের সামনে সহজে মুখ খুলতো না।আর এখন ভাষা যতই অশ্লীল হোক না কেন অভিভাবকের মুখের ওপর চোখে চোখে তাকিয়ে অকপটে উত্তর দিতে দ্বিধাবোধ করে না। আগে যে বয়সে পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার গর্বে আনন্দে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত হতো আজ সেই বয়সে অপরপক্ষের ইতিবাচক দৃষ্টি আকর্ষণের রেসপন্স পেলে মনে করে যেন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে।
সেই ছোট্ট ছেলেটি বা মেয়েটি লুকিয়ে লুকিয়ে এসএমএস পাঠায় বিপরীত পক্ষকে। আর অপরদিক থেকে শুরু হয় পরের ধাপ। দ্রুত বন্ধু মহলে ছড়িয়ে পড়ে তার প্রভাব। স্কুল–কলেজের নামে এভাবে ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন বেরিয়ে যায়। বিশ্বাস ভঙ্গ করে মা–বাবার। ধোকা দেয় অভিভাবককে প্রতিনিয়ত। আবদার মেটাতে বাইক কিনে দেয় বাবা ছেলেকে। ছেলে বাইক নিয়ে কখনো ভোর সকালে কখনো গভীর রাতে ছোট কোনো উছিলা বা অজুহাতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ছেলেরা। আনন্দ মাস্তি হৈ হুল্লোড় করে শেষে কোনো একটা অঘটন ঘটায়।
পরের দিন খবরের কাগজের ব্রেকিং নিউজ হয়। সন্তান হারা হয় মা–বাবা। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে নীতি–নৈতিকতা মানে আগের যুগের কথা। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট যুগের কথা। ওরা এসব রীতিনীতির কথা শুনতে চায় না। একটু চীল থাকতে চায়। বই কিনে দেবেন বস্তায় বস্তায়।
বছর শেষ হয়ে যাবে। বই পুরানো হবে না। আবার বিক্রি করতে পারবেন। পড়ালেখা করবে ক্লাস করবে টেন মিনিটস স্কুলের ক্লাস দেখবে জ্ঞান অর্জন করবে, খুবই জরুরি। মোবাইল ফোন আপনাকে দিতেই হবে। তারপর? তারপর কী করবে আপনি হিসেব মেলাতে পারবেন না। খেই হারিয়ে ফেলবেন। অর্থাৎ দিলেও জ্বালা না দিলেও জ্বালা।
ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু বলতে যাবেন তো বেঁকে বসবে হয়তো খাওয়া–দাওয়া বন্ধ করে দেবে। আর খাওয়া–দাওয়া বন্ধ করলে আপনার সন্তান অসুস্থ হয়ে যাবে। তাও আপনারই ক্ষতি। টানাটানি করতে হবে আপনাকে। টেনশন আপনার।
কথা না শুনলে যদি কখনো রাগ করে বলেন, বেরিয়ে যা, দেখবেন বেরিয়ে গেছে আর বাসায় ফিরছে না। তখনও আপনার টেনশন। ওদের এসব যন্ত্রণার কারণে ভাবছেন বিয়ে দিয়ে দেবেন। তাতেও আপনার সমস্যা। লোকে বলবে, ও তো অল্প শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত। তার ওপর অল্প বয়সে বিয়ে! এসব কারণে মা–বাবাই সবচেয়ে বড় অসহায়। সংযম, পরোয়া, স্থিরতা, শ্রদ্ধা, অন্যকে গুরুত্ব দেওয়া, সম্মান দেখানো– এসব গুণাবলী শিশু–কিশোর এবং একজন মানুষের মধ্যে থাকাটা যে কতটা জরুরি এই ব্যাপারটা ক্লাসে ক্লাসে ঘরে–বাইরে নীতিবাক্য হিসেবে গল্পে গল্পে তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি।
কর্মব্যস্ত জীবনের তাড়নায় পরিবারের সকল সদস্য একিভূত হতে না পারলেও অন্তত রাতে খাবার টেবিলে নীতিকথা আদর্শ সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য অভিভাবক মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যেন বিজ্ঞান–প্রযুক্তির কুপ্রভাবে জর্জরিত না হয়ে কল্যাণটা গ্রহণ করতে পারি। আমরা কি আশা করতে পারি না এমন একদিন আসুক সমাজের উঁচু নিচু সমস্ত শিশু–কিশোরের মধ্য থেকে নেতিবাচক ধ্যান–ধারণা, বিজ্ঞান প্রযুক্তির কুপ্রভাব, অপসংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাবে?
যাদের পরিবারে রয়েছে অর্থের টানাপোড়েন তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তারা ঘরে মা–বাবার কাছে দু দণ্ড বসতে পারে না। কারণ ঘরের ভেতরে সময় কাটানোর মতো পরিবেশ নেই। যতক্ষণ দিনমজুরের কাজ করে তারপরের সময়গুলো বাইরে বাইরে ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দেয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আড্ডা দেয়। যার তার সাথে মিশে যায়। ভালো ছেলেরা খারাপ আর খারাপ ছেলেরা আরো খারাপ হয়ে যায়। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন এভাবে দল গঠন হয়। শুরু হয় গ্রুপিং। গড়ে ওঠে আস্তানা। শুরু হয় মিশন। এর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে সমাজের পরতে পরতে। ভাইরাস প্রবেশ করে সুস্থ সবল ছেলেমেয়েদের শরীরে। আক্রান্ত হয় সমাজ। সবকিছু চলতে থাকে ফাঁকপোকরের তালে তালে সমানে সমান। শুধু অসহায় পড়ে থাকে দুর্বল মা–বাবা যাদের শাসনের যন্ত্র আর চলে না যত্নে লালন করা বড় হতে থাকা সন্তানদের ওপর।