পীরানে পীর বড় পীর হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। ১১ রবিউস সানি তাঁর ওফাত বার্ষিকী। ইরানের উত্তরাঞ্চলে কাস্পিয়াম সাগরের তীরে গিলান প্রদেশের বাসিন্দা বিধায় গিলানী। আমাদের দেশে উচ্চারণগত ব্যবধানে জিলানী। তিনি উচ্চতর জ্ঞানের লক্ষে বাগদাদে আগমন করেন। দীর্ঘ ৭৩ বছর বাগদাদে অবস্থান করে এখানেই ইন্তেকাল হয়ে যান। তাঁর কারামতের ভান্ডার বিশাল। অপরদিকে তিনি ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। ছিলেন তেমনি অতীব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি যখন বাগদাদে আগমন করেন তখন মুস্তাজহির বিল্লা, অতঃপর মুস্তারশিদ, রাশেদ, আল–মুকতাদী লি আমরিল্লাহ ও আল–মুস্তানজিদ বিল্লাহ যথাক্রমে খলিফার আসনে সমাসীন হন। ফলে হযরত পীরানে পীর দীর্ঘ সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বাস্তব সাক্ষী।
হযরত পীরানে পীর খলিফাগণ তাদের উজির তথা মন্ত্রীবর্গসহ দুনিয়ার উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণকে এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু তাঁর সান্নিধ্যে আসতে তারা ঘুরঘুর করত। অপরদিকে তিনি ছিলেন সীমাতিরক্ত বিনয়ী। কোন শিশু কিংবা কোন বালিকা কথা বললে তিনি দাঁড়িয়ে তা শুনতেন। তার ফরমায়েশ মত কাজ করে দিতেন।
অভাবী ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের নিকট তিনি বসতেন এবং তাদের কাপড়–চোপড় পরিষ্কার করে দিতেন। অপরদিকে সাম্রাজ্যের কোন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সম্মানার্থে তিনি দাড়াতেন না। খলিফা বা তাঁর উজির মন্ত্রীর আগমন ঘটলে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আপন গৃহে চলে যেতেন। খলিফা বা খলিফার প্রতিনিধি এসে বসলে, তারপর তিনি আন্দর বাড়ী থেকে সামনে আসতেন। যাতে এই সব দুনিয়াবী সম্মানীর সম্মানার্থে তাকে দাঁড়াতে না হয়। তিনি জীবনে কোন দিন বা কোন সময় খলিফা বা উজিরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াননি।
ইমাম হাফিজ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ আল–বারযালী আল আশবেলী তাঁর প্রশংসায় বলেন :
তিনি যে দোয়া করতেন তা কবুল হত অর্থাৎ তিনি মুস্তাজাবুদ্দাওয়াত ছিলেন।
ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়াতে ও অভাবী লোকদের প্রয়োজন পূরণে তিনি দেদার অর্থ ব্যয় করতেন এবং এতে আনন্দ পেতেন।
আল্লামা ইবনুল–নাজ্জার শায়খ জিলানী (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন: গোটা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদই যদি আমার হাতে চলে আসে তাহলে আমি সবটাই ক্ষুধার্তদের মধ্যে বিলিয়ে দেব। তিনি আরও বলতেন: মনে হয় আমার হাতে কোন ছিদ্র আছে। তাই কিছুই আমার হাতে থাকে না। যদি হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা)ও আমার হাতে আসে তবু দেখা যায়, রাত পোহাবার আগেই তা শেষ হয়ে গেছে।
কা’লাইদুল–জাওয়াহির প্রণেতা লিখেন: শায়খ (রহ.) এর নির্দেশ ছিল, রাতের বেলা প্রশস্ত দস্তরখানা বিছানো হবে। তিনি নিজে মেহমানদের সাথে বসে খানা খেতেন, গরীব ও দুর্বল লোকদের সঙ্গ দিতেন এবং ছাত্রদের জিজ্ঞাসাসমূহ ধৈর্য সহকারে শুনতেন।
বিশ্বের ইতিহাসে হযরত বড় পীরের কারামতের আধিক্য সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত।
আহলে হাদীস তথা সালাফিদের ইমাম শায়খুল ইসলাম ইযযুদ্দীন ইবন আবদুস সালাম ও ইমাম ইবনে তায়মিয়ার উক্তি: শায়খ (রহ.) এর কারামত সংখ্যার গন্ডী ছড়িয়ে গিয়েছিল। তন্মধ্যে তাঁর সর্বাপেক্ষা বড় কারামত হল মুর্দা দিলকে জীবিতকরণ। আল্লাহ তাআলা তাঁর কলবের তাওয়াজ্জুহ ও মুখের তা’ছীরে লাখো মানুষকে ঈমানী জিন্দেগী দান করেছেন। তাঁর অস্তিত্ব ছিল ইসলামের জন্য বসন্ত সমীরণের ন্যায়, যা মৃত দিলের মাঝে নবতর প্রাণ–স্পন্দন সৃষ্টি করেছে এবং মুসলিম জাহানে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার এক নতুন জোয়ার বইয়ে দিয়েছে।
শায়খ উমর কিসানী বলেন: শায়খের এমন কোন মজলিস বসত না যেখানে ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের কেউ না কেউ ইসলাম গ্রহণ না করত। ডাকাত, খুনি ও নানাবিধ পাপে লিপ্ত লোকেরা তওবাহর সৌভাগ্য লাভ করত এবং ভ্রান্ত আকীকা–বিশ্বাসের লোক তাদের ভ্রান্ত আকীদা বিশ্বাস থেকে তওবাহ করে সঠিক পথে ফিরে আসত।
হযরত জুবাঈ বর্ণনা করেছেন, আমাকে একবার হযরত শায়খ (রহ.) বললেন: আমার মন চায় আগের যুগের মত মাঠে–ময়দানে ও জঙ্গলে গিয়ে অবস্থান করি। আল্লাহর কোন মখলূক যেন আমাকে না দেখে আর আমিও যেন কাউকে না দেখি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের কল্যাণ চান; আমার হাতে পাঁচ হাজারের বেশি ইয়াহূদী ও খ্রিস্টান মুসলমান হয়েছে। ধূর্ত, প্রতারক ও পেশাদার পাপীদের ভিতর থেকে লাখের অধিক লোক আমার হাতে তওবাহ করেছে। এও আল্লাহর এক বিরাট নিয়ামত।
ঐতিহাসিকদের মতে, বাগদাদে এমন সংখ্যা কম নয় যিনি হযরত বড় পীরের হাতে তওবা করেননি।
হযরত পীরানে পীরের একটি অতি সাহসী পদক্ষেপ বহুল আলোচিত আর তা হল:
কালাইদুল জাওয়াহির প্রণেতা লিখেছেন: খলিফা মুকতাফী লি–আমরিল্লাহ একজন কুখ্যাত ব্যক্তিকে কাজী নিযুক্ত করলে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) প্রকাশ্যে মিম্বরে দাঁড়িয়ে খলিফাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন: তুমি মুসলমানদের উপর এমন এক ব্যক্তিকে শাসক নিযুক্ত করেছ যার চাইতে বড় জালিম আর নেই। কাল কিয়ামতের ময়দানে তুমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, যিনি আরহামুর রাহীমীনও বটে এর সামনে এর কী জওয়াব দেবে?
উক্ত ঐতিহাসিক আরও বলেন, খলিফা একথা শুনে শিউরে উঠে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং তখনই উক্ত কাজীকে তার পদ থেকে অপসারিত করেন।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) সেই সব “দরবারী ও সরকারী” আলেম ওলামা ও মাশায়েখদের কঠোরভাবে প্রত্যাখান করতেন এবং নির্ভীকভাবে তাদের স্বরূপও উদঘাটন করতেন, যারা তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি ছেড়ে ক্ষমতাসীনদের মোসাহেবী অবলম্বন করেছিল এবং ওদের সুরে সুর মেলানো যাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল, যাদের কারণেই আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে ঐ সব সুলতান ও শাসকদের দুঃসাহস আরও বেড়ে গিয়েছিল।
হযরত পীরানে পীর দামী পোশাক ব্যবহার করতেন। তিনি সহজে মানুষের হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। কেউ কিছু দিলে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। খলিফা মনসুরের পুত্র ইউসুফ এক থলী স্বর্ণ মুদ্রা উজির/ মন্ত্রীর মাধ্যমে পাঠান, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।
তিনি সপ্তাহে ৩ দিন নসিহত করতেন। শুক্রবার জুমার পর মসজিদ প্রাঙ্গণে, শনিবার রাতে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে, বুধবার বাদ ফজর ঈদগাহ ময়দানে।
খলিফা থেকে আরম্ভ করে জ্ঞানী–গুণী, আলেম–ফাজেল, সুফি–দরবেশ, ইহুদি–খ্রিস্টান–মুশরিক, কুলি–মুজুর লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। তার নসিহত শুনতে শুনতে মানুষ আত্মহারা হয়ে যায়। বাদশাহ খলিফা উজিরবৃন্দ তার মজলিসে অত্যন্ত আদবের সহিত বসতেন। একেক মজলিসে শত শত কালির শিশি ও কলম থাকত তার বাণী সমূহ লিখে নেয়ার জন্য। তার মজলিসে সমাগম এত বেশি ব্যাপকতা লাভ করত যে, মাঠে নিকট ঘরসমূহের ছাদে, এমনকি সড়কের উপরেও জ্ঞানার্জনকারীরা অবস্থান নেন। শুধু বাগদাদে নয়, তাঁর নিকট জ্ঞানার্জনের জন্য জ্ঞানপিপাসুরা অনেক দূর থেকে আসতে শুরু করে। এতে তিনি ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। বিশেষ করে তাফসীর, হাদীস,ওসুল, আকায়েদ, আদব–কায়দা, আচার–ব্যবহার ইত্যাদি।
হযরত পীরানে পীর অনেক অমূল্যগ্রন্থ রচনা করে গেছেন: তৎমধ্যে কয়েকটি হল-(১) গুন্ইয়াতুত ত্বালেবীন (২) আল–ফাত্হুর–রাব্বানী (৩) ফুতহুল গুয়ুব (৪) হিযবুল বোশাইরী (৫) জিয়াউল খাতির (৬) আল–মাওয়াহিবুর–রাহমানিয়া (৭) ওয়াকেয়াতুল হিকাম (৮) আল–ফায়েদাতুর রাব্বানিয়া ফিল–আওরাদিল কাদিরিয়া (৯) বাহ্জাতুল আসরার।
বস্তুতঃ হযরত বড় পীর জিলানী ইরানের গিলান প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন ৪৭০ হিজরি তথা ১০৭৭/৭৮ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর আব্বা আম্মা ইরানের গিলানে শায়িত।
এ মহান পীরানে পীর ৫৬১ হিজরি ৯১ বছর বয়সে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদ বাসীর নিকট তিনি শায়খ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শায়খ অর্থ নেতা।
১৯৯৭ সালে হজের পরপর জর্ডানের রাজধানী আম্মান হয়ে সড়কপথে সপ্তাহখানেকের জন্য ইরাক গমন করার সুযোগ হয়।
হযরত বড় পীর (রহ.)’র মাজার থেকে ৩/৪ শ কি.মি দূরত্বে একটি হোটেলে অবস্থান নিই আমরা বাংলাদেশী ১৮ জন যেয়ারতকারী। এতে বারে বারে তাঁর মাজার কমপ্লেক্সে গমন করে নামাজ পড়ার পাশাপাশি যেয়ারত করার সুযোগ হয়। প্রায় আধা কি.মি বা তার কম বেশি এরিয়া নিয়ে তাঁর মাজার কমপ্লেক্স। মাজার সংলগ্ন প্রকান্ড মসজিদ তাঁর পরিবারবর্গের কবরস্থান, মাদ্রাসা, গেস্ট হাউস, অফিসাদী রয়েছে। বাগদাদে অবস্থানকালে কুফা, নজফ, কারবালা, কাজেমাইন, মসুল গমন করা হয়েছিল যেয়ারতের উদ্দেশ্যে।
অপরদিকে ২০০৫ সালে ১ম বার ইরান সফর করা হয়। ইরান এয়ারের ভোরের ফ্লাইটে তেহরান থেকে গিলান প্রদেশের রাজধানী রাস্ট গমন করা হয় ১ দিনের জন্য। তখন প্রাদেশিক রাজধানীর অনতি দূরে হযরত পীরানে পীরের আম্মাজান হযরত উম্মুল খায়ের এর যেয়ারতে গমন করা হয়েছিল। উনার আব্বাজানের কবর অনেক দুর্গম এরিয়ায় বিধায় যেয়ারতে যাওয়া হয়নি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট