কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ চট্টগ্রামবাসী তথা দেশবাসীর জন্য একটি বিশেষ স্থাপনা। টানেলের সংযোগ সড়কের জন্য নদীর উভয় পাড়ে সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রয়োজন স্বভাবতই। এ লক্ষ্যে পশ্চিম পটিয়া কর্ণফুলী থানার ওয়াই জংশন (ক্রসিং) থেকে আনোয়ারা মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় ১০ কি.মি সাবেক সরু রাস্তা ৬ লেইনে উন্নীত হয়ে গেছে প্রায়। শতকরা ৮০ ভাগ কাজ শেষ। চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগণ ত বটেই সারা বাংলাদেশের মানুষ কক্সবাজার গমনকালে ওয়াই জংশনে (ক্রসিং) ৬ লেইনে উন্নিত দৃশ্যমান দেখে আনোয়ারা বাঁশখালী পেকুয়া হয়ে কক্সবাজার গমন এক প্রকার শুরু হয়ে গেছে। এতে ২৫/৩০ কি.মি উত্তর দক্ষিণ দৈর্ঘ্য বাঁশখালীর একমাত্র প্রধান সড়কের ভয়াবহ যানজট চলমান। সাথে টইটং পেকুয়া চৌমুহনীতে যানবাহনের অসহনীয় চাপ।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার আনোয়ারা বাঁশখালী পেকুয়া উপজেলার ভয়াবহ যানজটের সুরাহা না করে বঙ্গবন্ধু টানেল খুলে দিলে এখানকার পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় পরিণত হবে। বাঁশখালী পেকুয়া সহ ঐ এলাকার ৮/১০ লাখ মানুষের যাতায়াতে অতীব দুর্বিষহ পরিস্থিতি হয়ে যাবে।
গত ১০/১৫ বছর থেকে পশ্চিম চকরিয়া পেকুয়া মহেশখালী কুতুবদিয়ার লাখ লাখ জনগণ বাঁশখালী আনোয়ারা কর্ণফুলী থানা তথা পিএবি সড়ক হয়ে নিয়মিত আসা–যাওয়া করছে। ঐসব অঞ্চলে সকালে এসে বিকেলে ফিরে যাচ্ছে এমন সংখ্যাও কম নয়।
কর্ণফুলী টানেল করার অন্যতম কারণ দক্ষিণ চট্টগ্রাম কক্সবাজার জেলার যাতায়াতে সারা দেশের মানুষকে আরাম দেয়া। এতে কঙবাজার পর্যটন শহরে যাতায়াতের গুরুত্ব তো আছেই, সাথে এ টানেলের মাধ্যমে হয়ত চট্টগ্রাম শহর পশ্চিম পটিয়ায় আনোয়ারায় সমপ্রসারিত হয়ে যাবে।
মনে হয় কর্ণফুলী টানেল কর্তৃপক্ষ টানেল করতে গিয়ে আনোয়ারা বাঁশখালী পেকুয়া হয়ে সড়ক সমপ্রসারণ করার প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করে দেয়ার কাজ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তা করা হয়নি। মনে করি ইহা টানেল নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব। যে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে তার ভবিষ্যত কার্যকারিতা প্রতিফলন সব কিছু মাথায় রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু টানেল কর্তৃপক্ষ আনোয়ারা সীমান্তে টানেলের মুখ থেকে মাত্র ৫/৭ কি.মি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে পশ্চিম পটিয়া আনোয়ারা বাঁশখালী (পিএবি) সড়কে সংযোগ দিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথে পশ্চিম পটিয়া আনোয়ারা বাঁশখালী সড়কে ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা কালা বিবির দিঘী পর্যন্ত মাত্র ৮/১০ কি.মি সড়ককে ৬ লেইনে উন্নীত করে দেয়া হচ্ছে।
কর্ণফুলী টানেল যখন খুলে দেয়া হবে সারা বাংলাদেশের মানুষ পতেঙ্গা কর্ণফুলী টানেল পার হয়ে আনোয়ারার মধ্যখানে এসে বাঁশখালী পেকুয়া হয়ে কক্সবাজার যেতে চাইবে স্বাভাবিক। কর্ণফুলী টানেলের সংযোগ সড়কের শেষ মাথা হতে পটিয়া আরাকান রোড হয়ে কক্সবাজার এর দূরত্ব হবে ১৪২ কি.মি.। বাঁশখালী চকরিয়া হয়ে ১১০ কি.মি কম দূরত্ব, রাস্তা সোজা করলে এ দিকে দূরত্ব আরও কমবে। যেহেতু এই পয়েন্ট থেকে (বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার ১১০ কি.মি.) তখন বাঁশখালী যানজট চলমান পেকুয়া ও পশ্চিম চকরিয়া কুতুবদিয়া মহেশখালীর ৮/১০ লাখ মানুষের কেমন অবস্থা দাঁড়াবে!
বর্তমানে পিএবি সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে সকাল ৭/৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৭/৮ টা পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ ঘন্টা কম বেশি যানজট লেগেই থাকে। তৎমধ্যে আছে আনোয়ারা তৈলারদ্বীপ সরকারহাট, বাঁশখালীতে চাঁনপুর–চৌমুহনী, গুনাগরী–চৌমুহনী, বাণীগ্রাম, রামদাসহাট, বৈলছড়ী খান বাহাদুর বাজার, জলদী মিয়ার বাজার, চাম্বল বারী হাট, প্রেম বাজার, পেকুয়া উপজেলার বজল মিয়ার বাজার, পেকুয়া সদর, কবির মিয়ার বাজার।
পশ্চিম পটিয়া ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দিঘি পর্যন্ত ৮/১০ কি.মি ৬ লেইনে উন্নীত হওয়ায় পশ্চিম চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া জনগণের যানবাহন আনোয়ারা বাঁশখালী হয়ে যাতায়াত করতেছে। সাথে বিভিন্ন কোম্পানীর যাত্রীবাহী বাস।
অবাক করা ব্যাপার মগনামা ঘাট, মহেশখালী সদর, বদরখালীতে কয়েক কোম্পানীর বাস স্টেশন হয়ে গেছে। ১৫/২০ মিনিট অন্তর অন্তর বাস ছাড়ছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আর বাসগুলো আসা উচিত হবে বানিয়াছড়া হয়ে আরাকান মহাসড়ক দিয়ে। যাওয়া আসা এক লাইনে হলেও এ মহাসড়কের প্রশস্ততা বিশাল। পটিয়া ইন্দ্রপুল, দোহাজারী, চন্দনাইশ, চকরিয়া বড় বড় ব্রীজগুলি বিশালভাবে পুনঃনির্মাণ হয়ে গেছে। ওয়াই জংশন থেকে কেরানী হাট পর্যন্ত আরাকান মহাসড়কের প্রশস্ততা আরও বাড়ানো হচ্ছে।
কিন্তু বাঁশখালী আনোয়ারা হয়ে ৩০/৪০ কি.মি দূরত্ব কম বিধায় এখানে সরু রাস্তার উপর যাত্রীবাহী বাসগুলো চাপ সৃষ্টি করে যাতায়াত করছে। আগে ছিল কোস্টার আকৃতির ২৫/৩০ জনের ছোট বাস। এখন চলছে বড় বড় বাস। বাঁশখালী আনোয়ারায় এত সরু রাস্তা দিয়ে বড় বড় অসংখ্য বাস যাতায়াতের আইনগত অনুমতি আছে কিনা দেখতে হবে। মনে হয় না এসব কিছু দেখভাল তদারক করার জন্য সড়ক বিভাগের বা হাইওয়ে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষ আছে।
বাঁশখালী পেকুয়ার ৮/১০ লাখ মানুষের বর্তমানকালে যাতায়াতে দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে। তার মূলে ভয়াবহ যানজট।
যানজট মুক্ত রাখার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করার ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিক নির্দেশনা আছে বলে মনে হয় না। আজ ৮/১০ লাখ বাঁশখালী পেকুয়া উপজেলার মানুষ ভয়াবহ যানজটের কাছে অসহায়। ৮/১০ স্থানে যানজট লেগেই থাকে। একেক যানজট ১০/১৫ মিনিট, কোনো কোনো সময় এক ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়। স্থবির ভাবে থেমে থাকতে হচ্ছে। তখন দেশে স্থানীয় প্রশাসন আছে তা অনুভব হয় না।
শুধু বঙ্গবন্ধু টানেল নয় আমাদের দেশে এমন শত শত বা হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে, হচ্ছে যেগুলোর সুদূর প্রতিফলন ঢাকা বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক কক্ষে বসে মনে হয় বিজ্ঞজনের মাথায় আসছে না।
যার জ্বলন্ত উদাহরণ বঙ্গবন্ধু টানেল এবং দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন। কালুরঘাট সেতু পৃথকভাবে নতুন নির্মিত হয়নি, দোহাজারী পর্যন্ত ব্রীজ পুনঃনির্মাণ, রেল লাইন উন্নীত করা হয়নি, কাজ শুরুর খবরই নেই ষোলশহর থেকে ফৌজদারহাট কট লাইন নির্মাণের। কাজেই দোহাজারী–কক্সবাজার নতুন রেল যোগাযোগের সুফল আসতেই পারে না।
বঙ্গবন্ধু টানেল এবং দোহাজারী–কঙবাজার রেল নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো যাবে। কিন্তু এ দুটি হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের শতভাগ সুফল সুদূর পরাহত। দীর্ঘ ৩০/৪০ বছর দেশের জনগণের কল্যাণে এ (পিএবি) সড়কটি উন্নয়ন সমপ্রসারণের কথা বারে বারে বলা হয়ে আসছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাস্তবতার সুফল আজও নেই। ঐ এলাকার এ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সরু সড়কটি উন্নয়ন সমপ্রসারণ না করে কর্ণফুলী টানেল হয়ে হাজার হাজার ছোট বড় যানবাহনের চাপ এ (পিএবি) সড়কের উপর চেপে দেয়া গ্রহণযোগ্য হবে না।
অতএব, যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট বিনীত নিবেদন পতেঙ্গায় বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের পূর্বে জরুরি ভিত্তিতে বাঁশখালী–পেকুয়া সরু দুই লেইনের পিএবি সড়কটি অতি দ্রুত উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ করা হোক। যাতে এ অঞ্চলের লাখ লাখ জনগণ দুর্বিষহ ভয়াবহ যানজট থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক